মানিকগঞ্জে শত বছরের নৌকার হাট এখনো জমজমাট

770
মানিকগঞ্জে শত বছরের নৌকার হাট এখনো জমজমাট

মানিকগঞ্জে নদ নদীর পানি কমতে শুরু করলেও বর্ষার পানি থৈ থৈ করছে চারদিকে। বর্ষা এলেই নৌকার চাহিদা বেড়ে যায়, তাই নৌকা তৈরিতে শ্রমিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

জেলার ৭টি উপজেলার ৬৫টি ইউনিয়নই এখন বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত। আর বন্যার পানি না থাকলেও পদ্মা ও যমুনা, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা ও ইছামতি নদীর তীরবর্তী মানুষদের নৌকা ছাড়া চলাচলের অন্য কোন মাধ্যম নেই। অপর দিকে চলতি বন্যায় জেলার ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

পানিবন্দি মানুষের বাহন নৌকা তৈরির কারখানার শ্রমিকরা এখন নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। আর জেলার হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকার শতবর্ষী নৌকার হাটও জমে উঠেছে।

এ নৌকার হাটে জেলার ঘিওর, হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা ছাড়াও ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ উপজেলাসহ পদ্মা ও যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ নৌকা কিনতে ভিড় জমাচ্ছে। প্রতিদিনই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ নৌকার হাট।

সরেজমিনে জানা গেছে, জেলার অধিকাংশ অঞ্চল চলতি বন্যায় তলিয়ে গিয়েছে পানিতে। অনেকে বন্যার পানি দ্রুত সরে যাবে ভেবে এতোদিন নৌকা না কিনে অন্যের নৌকায় অথবা কলাগাছের ভেলায় চলাচল করেছে। আবার কয়দিন পরেই পবিত্র ঈদুল আজহা। সকলের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে আসতে শুরু করেছে লোকজন। তাই এ সময় চারদিকে পানি থাকায় নৌকার কদর বেড়ে গেছে। পানি স্থায়ী হওয়ায় নৌকা কিনতে ঝিটকায় শতবর্ষী নৌকার হাট ও ঘিওরে বৃহত্তম নৌকার হাটে ভিড় করছে অনেকেই।

ঘিওরের ঈদগা মাঠে সপ্তাহের প্রতি বুধবার ও ঝিটকায় প্রতি শনিবার হাটের দিন হলেও বন্যার কারণে সপ্তাহ জুড়েই ব্যাপক বিক্রি হচ্ছে নৌকা। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রেতারা নৌকা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখে হাটে।

কড়ই, চাম্বুল, ওরিয়ান, লোহা, রেইন ট্রি, কদম, জিকা কাঠের ১০-১২ হাতের নৌকা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ হাটে ডিঙ্গি বা কোষা নৌকার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি।

অন্য খবর  আজ ৮ মার্চ; ৭১ এর এই দিনে

ঝিটকা বাজারের নৌকা তৈরির শ্রমিক লিয়াকত আলী জানান, একটি নিম্নমানের কাঠের নৌকা একদিনেই তৈরি করতে পারলেও উন্নত মানের কাঠের নৌকা তৈরিতে সময় লাগে ২-৩ দিন। এ হাটে নৌকা সরবরাহ করার জন্য হরিরামপুর উপজেলার ২০-২৫ টি নৌকা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় প্রায় ২ শতাধিক নৌকা তৈরির শ্রমিক কাজ করছে।

তিনি আরও জানান, সাভার থেকেও বেপারীরা নৌকা আনেন এ হাটে। সারা বছর অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলেও বর্ষার ৩

মাস তারা নৌকা তৈরির কাজ করে লাভবান হয় বেশি।

ঝিটকা হাটের নৌকা বেপারী রেজাউল করিম জানান, ঝিটকার হাটের দিন ৫ থেকে ৬ শতাধিক নৌকা বিক্রি হয়। তাছাড়া এ বছর বন্যার পানি বেশি থাকায় হাট ছাড়াও প্রতিদিন নৌকা ভালো বিক্রি হচ্ছে।

হরিরামপুর উপজেলার গৌরিনাথপুর গ্রাম থেকে নৌকা কিনতে আসা রেজাউল করিম বলেন, “বাড়ির চারদিকেই পানি, নৌকা ছাড়া কোথাও যাওয়া যায় না। তাই নৌকা কিনতে আসলাম।”

নৌকা ব্যবসায়ী মুন্নু জানান, চলতি বছরে ১০ থেকে ১২ হাতের কোষা নৌকার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। নিম্নমানের এই নৌকা ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যেই পাওয়া সম্ভব।

এছাড়া ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে ভালো মানের নৌকা পাওয়া যায় বলেও জানান তিনি।

ঝিটকার নৌকা হাটে ক্রেতা ও বেপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা প্রতি বছর বর্ষায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন এ ধরনের ক্রেতারা বেশি দামের নৌকা কেনেন। আর যারা অতিরিক্ত বন্যা হলে পানিবন্দি হয়ে পড়েন তারা এক মৌসুমের জন্য কম দামের নৌকা কিনেন।

নৌকার তৈরির মহাজন সাইদুর বলেন, “১২ বছর ধরে নৌকা তৈরির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করি। এ বছর বন্যার পানি বেশি হওয়ায় নৌকা বেশি বিক্রি হচ্ছে।”

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা ছাড়াও ঘিওর উপজেলায়ও নৌকার হাট জমে উঠেছে। জেলায় বর্ষা মৌসুমে নৌকার চাহিদা মিটায় হরিরামপুরের ঝিটকা ও ঘিওর উপজেলার নৌকার হাট। মানিকগঞ্জ জেলার বৃহত্তম নৌকার হাট ঘিওরে মানুষ ভিড় করছে নৌকা কিনতে।

অন্য খবর  যেভাবে ভালবাসা দিবস এলো

ঘিওর উপজেলার চার ইউনিয়নের ২০ গ্রাম ও দৌলতপুরের দুর্গম এলাকায় বর্ষায় নৌকা ছাড়া চলাফেরা করা সম্ভব নয়। উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো পারাপারে পুরোদমে ব্যবহার হচ্ছে ডিঙ্গি নৌকা। নৌকাশিল্পের জন্য বিখ্যাত ঘিওরের কারিগরদের তৈরি নৌকা এ উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হচ্ছে হরিরামপুর, শিবালয়, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়। নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে মিস্ত্রিপাড়ার নারী-পুরুষদের।

অন্যান্য বছরের মতো এবারও বর্ষার ঘিওর উপজেলা সদরের প্রধান ঈদগাহ মাঠের নৌকা বিক্রির হাট জমজমাট হয়ে উঠেছে। ওই হাটে ক্রেতাদের জন্য থরে থরে সাজানো রয়েছে বাহারি কয়েক শ’ নৌকা।

ঘিওর বাজারের কাঠমিস্ত্রি রবি সূত্রধর, নিলকমল সূত্রধর, মাসুদ ও হারেছ জানান, বর্ষা মওসুমে তারা নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত। সপ্তাহে তাদের কারখানা থেকে ৮ থেকে ১০টি নৌকা ঘিওর, দৌলতপুর, বরংগাইল, তরা এবং মহাদেবপুর হাটে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে লোহা ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। নৌকার আকার ও প্রকারভেদে তিন থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে লাভের অংশ আগের থেকে কমে গেছে।

ঘিওর হাটে নৌকা বিক্রেতা খগেন সূত্রধর জানান, ১০ হাত লম্বা এবং দুই হাত প্রস্থের একটি নৌকার মূল্য তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা। এরকম ১১/৩ সাইজের নৌকা চার হাজার, ১২/৩ সাইজের সাড়ে চার হাজার, ১৩/৩ সাইজের পাঁচ হাজার, ১৪/৩ সাইজের সাড়ে পাঁচ হাজার এবং ১৫/৩ সাইজের নৌকা বিক্রি করেন ছয় হাজার টাকায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের স্টিলের নৌকা বিক্রি করেন তিনি।

দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা এলাকার সিরাজ প্রামাণিক জানান, প্রতি বছর বর্ষায় তার একটি করে নৌকা কিনতে হয়। তবে এ বছর নৌকার চাহিদা বেশি থাকায় দাম একটু বেশি বলে জানান তিনি।

আপনার মতামত দিন