মা’কে ইউএনও’র কক্ষে প্রবেশে বাধা, এখন সেই মায়ের ছেলেই ইউ.এন.ও : আলোচিত দোহারের শামীম  

    1955

    নিউজ৩৯,বিশেষ প্রতিবেদক, তারেক রাজীবঃ  তিনি একজন কর্মবীর। তার বড় পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান; একই সাথে তিনি দোহার উপজেলার কার্তিকপুরের সন্তান। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা ইউ.এন.ও- শামীম হোসেন। দোহারের গর্ব শামীম হোসেন। ইতিমধ্যে হয়েছেন চট্টগ্রাম জেলার শ্রেষ্ঠ ইউএনও।

    শামীম হোসেন, জন্ম নিয়েছিলেন দোহারের আন্তা বাহ্রা গ্রামে। ১১ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন অষ্টম। ভাইদের মাঝে সর্ব কনিষ্ঠ। এমন পরিস্থিতিতে দোহার নবাবগঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিদেশ চলে যাওয়াটা সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জীবনকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি অদম্য জেদ, সাহস আর নিষ্ঠার দ্বারা। আজ তিনি সারা দেশে আলোচিত। আজ সারাদেশে তিনি দোহারবাসীর গর্বের সন্তান। পদ্মায় বাড়ী ভেংগে যাওয়ার পর চলে আসেন কার্তিকপুর গ্রামে। সেখানে কার্তিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে এস এস সি পাশের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে আসেন দেশসেরা নটরডেম কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা সাহিত্য ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে চান্স পান। কিন্তু বেছে নিলেন আজন্ম লালিত প্রিয় বিষয় ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যকে।

    দোহারের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক-রাবেয়া দম্পতির জীবনে খুব বেশি চাওয়া বা আকাঙ্ক্ষা ছিল না ।ছিল স্বপ্ন, ছিল অদম্য ইচ্ছ্বাশক্তি ও সন্তানদের প্রতি অগাধ আস্থা।  তবে তাদের মাঝে উৎকণ্ঠা ছিলো। ছিলো ‘তাগাদা’, ‘তাড়না’। সেই ‘তাড়না’ সন্তানদের ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার, ‘মানবসম্পদে’ পরিণত করার।

    ইউএনও শামীম হোসনের বাবা-মায়ের ১১ সন্তানের মধ্যে কেউ কাস্টমস অফিসার , কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট অফিসার, কেউ শিক্ষকতাসহ নামকরা পেশায় জড়িত। এর মাঝেই ঘটলো মন খারাপের ঘটনাটি।

    শামীম হোসেনের মায়ের জীবন যেন এক সংগ্রামী সফল মায়ের ইতিহাস। যে ইতিহাস অনুপ্রাণিত করে আমাদেরকে। আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যেতে, অক্লান্ত পরিশ্রমে যে যেকোন কিছুই হওয়া সম্বভ তা দেখিয়ে দেন ইউএনও শামীম হোসেন। বলে রাখা ভালো, গৃহিণী হলেও তাপসী রাবেয়া শিক্ষিত, সচেতন নারী। পারিবারিক কাজে তিনি নিজেই ছুটে যান, মোকাবেলা করেন সংসারের খুঁটিনাটি কাজ। ঘটনাটি ১০ বছর আগের। পারিবারিক প্রয়োজনে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার তৎকালীন ইউএনও’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন তাপসী রাবেয়া।

    কিন্তু কথা বলা দূরে থাক, দিনভর অপেক্ষা করে ইউএনও’র কক্ষেই প্রবেশ করতে পারেননি। দিনশেষে কষ্টের পাহাড় ডিঙিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেই কষ্ট শেয়ার করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন, আমার একটা সন্তান যদি ইউএনও হতো! মা’র দীর্ঘশ্বাসটা আর বড় হয়। বিসিএস দিয়ে ইউএনও হওয়ার মতো তার সন্তানদের মাঝে আর কেউ অবশিষ্ট নেই। এরমধ্যে ৫ সন্তানের সবাই কর্মস্থলে প্রবেশ করে ভালো চাকরি করছেন।

    কিন্তু মায়ের প্রতি অসম্মান, অবামননা মানতে রাজি নন রাবেয়া তাপসীর কনিষ্ঠ সন্তান শামীম হোসেন। তখন বান্দরবানের জেলসুপার তিনি। স্থির করলেন এ অবস্থায়ই বিসিএস দেবেন, মায়ের ইচ্ছা পূরণ করবেন!ইউএনও হয়ে মায়ের ‘অমর্যাদার’ প্রতিবাদ জানাবেন।

    কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব? জেল সুপারের পদ ছেড়ে ইউএনও হতে চাওয়ার ইচ্ছা কিংবা চেষ্টা অত সহজও নয়। এ অসহজ কাজটিকে সহজ করতে নেমে পড়লেন শামীম হোসেন। অদম্য স্পৃহার এ মানুষটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসম্ভবকে সম্ভব করা, অজেয়কে জয় করার প্রমাণ এর মধ্যে রেখেছেন। একে একে চারটি চাকরি ধরেন তা আবার ছেড়েও দিয়েছেন। জীবনের প্রথম চাকরি সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট। নতজানু, গৎবাধা জীবন পছন্দ নয় শামীমের। তাই ছেড়ে দিলেন সেনাবাহিনীর চাকরি।

    অন্য খবর  স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দোহার - নবাবগঞ্জের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক উৎসাহ

    উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানেই ভর্তি হবেন নাকি অন্য কোথাও পড়বেন-ভাবতে ভাবতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। অনার্স শেষ করে পূবালী ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলেন, হলেন ব্যাংক-অফিসার। বাংলাদেশ ব্যাংকে অডিট অফিসারের চাকরি পেয়ে ছাড়লেন পূবালী ব্যাংক। অডিট অফিসারের চাকরিতে গিয়ে দেখলেন-পুরাতন টাকা পোড়ানোই তার মূল কাজ। ভাবলেন এখানে টাকা পোড়াতেই পোড়াতেই জীবন যাবে-তাই করলেন না সে চাকরিও!

    এবার অংশ নিলেন ২৬ তম বিসিএস পরীক্ষায়। শিক্ষাক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে প্রভাষক হিসেবে সরকারি কলেজে যোগ দিলেন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। এখানে এসে দেখলেন নোংরা রাজনীতির খেলা। ছাত্রজীবনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখানে কাল হলো। সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন। এবার যুক্ত হলেন কারাগারের চাকরিতে। জেলসুপার হিসেবে যোগ দিলেন বান্দরবানে। কারাবন্দিদের সুখ-দুঃখের জীবন নিয়ে এখানেই থিতু হতে চেয়েছিলেন শামীম হোসেন।

    কিন্তু সেখানেও থাকলেন না। মায়ের প্রতি ইউএনও’র অমর্যাদা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। পণ করলেন প্রশাসন-ক্যাডারে যুক্ত হয়ে কর্মের মাধ্যমে মা’র প্রতি অবমাননার প্রতিবাদ জানাবেন।

    ২৮ তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন-ক্যাডারে যুক্ত হন। প্রথম পোস্টিং হয় পুরোনো কর্মস্থল বান্দরবানে। এখানে তিনবছর ভিআইপিদের প্রটোকল দেয়ার কাজ করেন। এরপর কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরার এসি ল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মা’র স্বপ্নের ইউএনও হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়।

    এই ব্যাপারে শামীম হোসেনের মামাতো ভাই জয়পাড়া মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক নজরুল ইসলাম খান নিউজ৩৯কে বলেন, ২৮ তম বিসিএস রেজাল্টের ফলাফল দেখে ও হতাশ হয়ে বাসায় ফিরে আসে। ও ভেবেছিলো ওর হয়নি। এরমধ্যে ওর এক বন্ধু বাসায় আসে মিষ্টি খেতে । ও বলে, মিষ্টি কেন খাওয়াবো,করেছিতো ফেল। তখন ওর বন্ধু বলে, আরে কানা – তুই প্রশাসন ক্যাডারে সারা বাংলাদেশ প্রথম হয়েছিস। তখনি ও সিএনজি নিয়ে চলে যায় পিএসসি অফিসে। গিয়ে দেখে ও সত্যি প্রথম হয়েছে।

    নজরুল ইসলাম খান নিউজ৩৯কে আরো বলেন, ও আমাদের ভাই। আমি ওর মামাতো ভাই। ও আমাদের, আমাদের দোহারবাসীর গর্ব। আমার গর্বের সীমা নাই। তার জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। ৮ম সন্তানের পারিবারিকভাবে কি ই বা মূল্য আছে? কিন্তু ও প্রমাণ করেছে পরিশ্রম ই সব এনে দিতে পারে যদি লক্ষ্য থাকে অটুট।  ওর মাঝে রয়েছে সৃজনশীলতা,ও গ্রামের ছেলে,তাই সে প্রকৃতি ও গ্রাম ভুলে নাই। সে আজ সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে।আশা রাখি আগামী দিনে ও অনুসরণ করবে। আজ সারা দেশে সে আলোচিত আর দোহার পুনরায় গর্বিত সন্তানে পরিচিত।

    অন্য খবর  ১ মাসের মধ্যে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সমস্যা সমাধান: বাণিজ্যমন্ত্রী

    ইউএনও শামীম হোসেন বলেন, ‘এখানে যোগ দিয়ে পরিবর্তনের রাউজান গঠনে মাননীয় সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী স্যারের সারথী হয়েছি। আমার কার্যালয়কে বানিয়েছি সর্বস্তরের মানুষের কার্যালয়। আমার ফোন খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা। যে কেউ, যে কোনো সময় আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ পান। জীবনের শেষসময় পর্যন্ত তূণমূলের সঙ্গে থাকতে চাই। হতে চাই তাদের সুখ-দুঃখের সারথী।’

    তবে নিজের আক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মা আমার বেঁচে নেই। প্রশাসন-ক্যাডারে যোগ দেয়ার খবরে মা অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। আমার ইউএনও হবার আগেই পৃথিবী ছেড়ে যান তিনি। মা নেই, চাইলেও তাকে আর পাবো না, পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার চাওয়া অনুযায়ী সাধারণ মানুষকে অহর্নিশ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তাতে যদি মা’র আত্মা শান্তি পায়! আমি কখনো স্বীকৃতি বা পদকের জন্য কাজ করিনা, আমি সবসময় নিজের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের মাটি ও মানুষের কল্যান ও উন্নয়নের চিন্তা করেছি। তারপরও আমাকে যে মর্যাদায় আল্লাহ অভিষিক্ত করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’

    ২০১৬সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ইউ এন ও এর দায়িত্ব নেন। এরপর যেন রুপকথার গল্পের মতো এগিয়ে নিয়েছেন রাউজান উপজেলাকে। সবার প্রিয় শামীম স্যার আজ এলাকাবাসীর আপনজন। গত এক বৎসর দায়িত্ব পালন কালে রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন রেজা রাউজান উপজেলা পরিষদের সামনে ফুলের বাগান উপজেলা পরিষদের আঙ্গিনায় ফুলের বাগান গড়ে তোলেন । রাউজান উপজেলা পরিষদ ভবনে কেউ আসলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন রেজার গড়ে তোলা ফুলের বাগান দেখে মনে হয় কোন পার্কে বেড়াতে এসেছে ।

    রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন রেজার সরকারী বাসভবনের সামনে ও পার্শ্বে, পেছনে গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও ফলের বাগান । রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন রেজা গত দেড় বৎসরে রাউজান শিল্পকলা একাডেমি, রাউজান উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা, স্কাউটস গার্ল গাইড কে সক্রিয় করে তোলে । সরকারী বেসরকারী অনুষ্ঠানে রাউজান শিল্পকলা একাডেমির শিল্পিরা গান, ও নৃত্য পরিবেশন করে আসছে ।

    রাউজান উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে খেলাধুলার আয়োজন করে ক্রীড়াঙ্গনকে সক্রিয় করে তোলেছে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন । এছাড়া ও রাউজানের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাংসদ এবি এম ফজলে করিম চৌধুরীর পৃষ্টপোষকতায় দুপুরের টিফিন প্রদান কার্যক্রম, সাংসদ এবি এম ফজলে করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে রাউজানে এক ঘন্টায় সাড়ে চার লাখ ফলজ গাছের চারা রোপন কর্মসুচি সফল করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন ।

    রাউজানে পুকুরের পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যর ঘটনায় ব্যতিত হয়ে রাউজান উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম হোসেন তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার সরকারী বাসভবনের পেছনের পুকুরে সাপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সকালে এলাকার শিশুদের সাতার শেখানোর কাজ করে আসছেন ।

    আপনার মতামত দিন