বৃষ্টির পানিতেই বন্যা দোহার পৌরসভায়

358

 

 

ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘরের ভেতর জানালার পাশে বসে ছিলেন লাবণী বেগম। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে গৃহবন্দী অবস্থা তাঁদের। উঠানভরা পানি বারান্দা ছুঁই ছুঁই করছে। চলাচলের জন্য উঠানের ভেতরে প্রথম হাতখানেক পরপর পাশাপাশি দুটো করে ইট পাতা হয়েছিল। এক ইট তলিয়ে যাওয়ার পর তার ওপর আরও একটি করে ইট পাতা হয়েছে। সেই ইটও তলিয়ে যাওয়ার পরে তার ওপর দিয়ে তক্তা বিছিয়ে দেওয়া। সেতুর মতো সেই তক্তার ওপর দিয়ে তাঁরা এঘর-ওঘর যাতায়াত করেন।

এ অবস্থা দোহার পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জয়পাড়ার আবদুল খালেকের বাড়ির। এই পানি বন্যার নয়, বৃষ্টির। নামতে না পেরে আটকে আছে। বৃষ্টির পানি আটকে গিয়ে দোহার শহরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাতটিরই বিভিন্ন মহল্লায় কমবেশি বৃষ্টির পানি আটকে আছে। এর মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডের আজাহার আলী সড়কের পাশে কোনো নর্দমা নেই। পানি জমে আছে। তার ভেতর দিয়েই লোকজন, যানবাহন চলছে। এ ছাড়া এই ওয়ার্ডের লটাখোলা, লটাখোলা বিলের পাড় এলাকাতেও পানি জমেছে। পাশেই ২ নম্বর ওয়ার্ডের চর জয়পাড়া, খালপাড়া, রায়পাড়া, বউবাজার, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বউগ্যার চক, উত্তর জয়পাড়া এলাকায় পানি জমে ছিল। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ব্যাটিয়া, দক্ষিণ জয়পাড়া, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের জয়পাড়া নুরুপুর, ঘোনা, খারাকান্দা, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর ইউসুফপুর, কাটাখালী এবং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দোহার ঘাট ও বানাঘাট এলাকায় পানি জমে ছিল।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জলাবদ্ধতাই দোহারবাসীর প্রধান সমস্যা। বছরের পর বছর তাদের বর্ষাকালে এই সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। শহরে বৃষ্টির পানি নেমে যাওয়ার মতো নর্দমা নেই। নিষ্কাশনব্যবস্থা কার্যত অচল। ইদানীং সামান্য বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা গেল, ৫ নম্বর ওয়ার্ডজুড়েই বৃষ্টির পানি আটকে আছে। লাবণী বেগমের স্বামী আবদুল খালেকের বাজারে হার্ডওয়্যারের দোকান। তাঁর ছোট দুই ভাই আবদুল মালেক ও আবদুল ওয়াদুদকে নিয়ে তাঁদের যৌথ পরিবার। চারদিকে টিনের ছাউনির পাকা ঘর। মাঝে বড় উঠান। সেই উঠানের এক কোণে হাঁস-মুরগির ঘর। অন্যদিকে রান্নাঘর। জ্বালানি কাঠ রাখার মাচান। লাবণী বেগম জানালেন, লাকড়ি জ্বালানো মেটে চুলা ডুবে গেছে। গ্যাসের চুলা-সিলিন্ডার এনে রান্না করতে হচ্ছে।

অন্য খবর  দোহারে হেরোইনসহ ২ জন আসামী গ্রেফতার

শৌচাগার, গোসলখানায় পানি উঠেছে। বাধ্য হয়ে বাড়ির বাইরের উঠানের এক পাশে মাটি ফেলে অস্থায়ী শৌচাগার ও গোসলের জায়গা করা হয়েছে। তিনি জানালেন, প্রতিবছরই বর্ষায় এই মহল্লায় পানি জমে। তবে এবারের মতো এমন ভয়াবহ অবস্থা আগে কখনো হয়নি। গতকাল মঙ্গলবার সর্বশেষ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি।

এই পরিবারটির মতোই একই অবস্থা বৃষ্টির পানিবন্দী প্রায় প্রতিটি পরিবারে। চলাফেরার সমস্যা তো আছেই; রান্না, গোসল, শৌচকর্ম এসব নিয়ে দুর্ভোগ হচ্ছে প্রচণ্ড। অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারে রান্না হয় লাকড়ির চুলায়। সাধারণত উঠানের এক প্রান্তে থাকে এসব মেটে চুলা। পানিতে চুলা ডুবে গেছে। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করেছেন। গ্যাসের সিলিন্ডার কেনার সামর্থ্য নেই যাঁদের, এমন পরিবারে রান্নার কষ্ট প্রচণ্ড।

কাদাপানি মাড়িয়ে বিকেলে আসা গেল ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গাঙপাড় মহল্লার বায়তুল নাজাত জামে মসজিদের সামনে। এখানে আসরের নামাজ আদায় করতে আসা স্থানীয় মুসল্লিরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করলেন পানিবন্দী অবস্থার দুর্ভোগ নিয়ে। বেগম আয়েশা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী শিক্ষক মাওলানা নূরুল ইসলাম বললেন, এই মহল্লায় প্রায় দুই শ পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে। মেয়র বা ওয়ার্ড কাউন্সিলর কোনো দিন এসে খোঁজও নেননি। সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তা দেখার কেউ নেই। স্থানীয় বাসিন্দা সামাদ মাতবর, মোহাম্মদ ব্যাপারী, নবাব আলী চোকদারসহ অনেকেই বলছিলেন, রাস্তা ডুবে আছে। বাড়ির উঠানে পানি। তাদের মসজিদের আসতে কষ্ট, ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজে যেতে কষ্ট। পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই আটকে থাকা পানিতে এখন মশার বংশবিস্তার ঘটছে। তাঁদের অভিযোগ পৌরসভা ট্যাক্স আদায় করছে ঠিকই, কিন্তু দুর্ভোগ কামানোর জন্য কিছু করে না।

অন্য খবর  দোহারে ইঞ্জিনিয়ার মেহবুব কবিরের শীতবস্ত্র বিতরন 

আবর্জনা ফেলার কোনো নির্দিষ্ট স্থান বা কনটেইনার না থাকায় এসব খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলা হয়। পানিতে সেই আবর্জনা আর আগাছা পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিছু কিছু এলাকায় সড়কও ভাঙা। মাঝে মাঝেই খানাখন্দ।

দোহার পৌরসভা প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ২০০০ সালে সর্বশেষ পৌর নির্বাচন হয়েছে। মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন বিএনপি নেতা আবদুর রহিম মিয়া। পাশের তিন ইউনিয়নের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণ নিয়ে মামলা চলছে বলে আর নির্বাচন হয়নি। প্রায় ১৭ বছর ধরে মেয়রের দায়িত্ব পালন করে ক্লান্ত ৮৪ বছর বয়সী আবদুর রহিম মিয়া প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমি অখন ছাইড়া দিবার চাই, কিন্তু পথ পাইতাছি না।’ জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ সম্পর্কে তিনি বলনে, এই এলাকাটি একটু নিচু। পৌরসভার ভেতরে আগে অনেক ডোবা, পুকুর প্রাকৃতিক জলাশয় এসব ছিল। জায়গার দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকে বাইরে থেকে মাটি এনে এসব জলাশয় ভরাট করে ফেলেছে। ফলে পানি যাওয়ার জায়গা নেই। তা ছাড়া অসংখ্য দালানকোঠা হচ্ছে। তাতে পানির প্রবাহও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

মেয়র অভিযোগ করেন, তিনি বিএনপি করেন বলে দোহার পৌরসভার উন্নয়ন বরাদ্দ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কেটেছেঁটে কমিয়ে দেওয়া হয়। দোহার প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও বার্ষিক উন্নয়নের জন্য ৬০ থেকে ৮০ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ পান না। তাঁর নয়টি ওয়ার্ড। প্রতি ওয়ার্ডের ভাগে ১০ লাখ টাকাও পড়ে না। এবার বরাদ্দ পেয়েছেন ৮০ লাখ টাকা। এ অবস্থায় তাঁর ভাষায় ‘টুক টুক করে’ উন্নয়নের কাজ চলছে।

আপনার মতামত দিন