বাদী-বিবাদী মারা যাওয়ার পরেও শেষ হয় না দেওয়ানি মামলা

486
বাদী-বিবাদী মারা যাওয়ার পরেও শেষ হয় না দেওয়ানি মামলা

১৯৬৪ সালে নিবারণ প্রামাণিক নামে এক ব্যক্তি ঢাকার নিম্ন আদালতে একটি দেওয়ানি মামলা করেন। ১৯৯৩ সালে তিনি মারা যান। মামলায় বাদী হিসেবে পক্ষভুক্ত হন তার ছেলে লক্ষ্মণ প্রামাণিক ও পরেশ প্রামাণিক। গত সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাদীর ছেলে লক্ষ্মণ প্রামাণিক মারা যান। এর চার/পাঁচ বছর আগে মারা যান মামলার বিবাদী আব্দুল জলিল। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি ওই মামলাটি। বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন। বাদী পক্ষের আইনজীবী এড. চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, এই মামলার বাদী নিবারণ প্রামাণিক মারা গেছেন।

এরপর তার দুই ছেলে লক্ষ্মণ ও পরেশ এই মামলায় পক্ষভুক্ত হন। কিন্তু ৯২ বছর বয়সী লক্ষ্মণ সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মারা গেছেন বলে স্বজনেরা জানান। আদালতের নির্দেশে লক্ষ্মণ প্রামাণিকের ওয়ারিশগণকে পক্ষভুক্ত করতে রোববার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র এফিডেভিট করে জমা দেয়া হয়েছে। গতকাল পক্ষভুক্তির শুনানি শেষে মৃতের ওয়ারিশগণকে পক্ষভুক্ত করা হয়েছে। আশা করি খুব শিগগিরই রায়ের তারিখ নির্ধারিত হবে। তবে হাইকোর্টের এই রায়ই চূড়ান্ত নয়। দু’পক্ষের যেকোনো পক্ষই আপিলে যেতে পারবেন। আপিলে গেলে সেখানে চলে যাবে প্রায় দুই থেকে তিন বছর।

নথি থেকে জানা যায়, নিবারণ প্রামাণিক পেশায় কৃষক। ১৯৫০ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে চলে যান যশোরে। যাওয়ার সময় নিজের ভাগ্নে গৌর চন্দ্র মণ্ডলকে ১০ একরের বেশি সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান। দুই বছর পর ফিরে এসে সম্পত্তি আর ফেরত পাননি। পরে আদালতের দ্বারস্থ হন তিনি। ১৯৬৪ সালে নিম্ন আদালতে দায়ের করা হয় মোকদ্দমা। পাকিস্তান আমলে করা ওই মামলায় ১৯৮৩ সালে নিম্ন আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন। যাতে মামলার বিবাদী (নিবারণের ভাগ্নে গৌর চন্দ্র মণ্ডল) জমি বিক্রি করতে না পারেন। তবে ১৯৯১ সালে ভাগ্নে বিনিময় দলিলের মাধ্যমে ৯৮ শতাংশ জমি আবদুল জলিল নামের এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করেন। এর দুই বছর পর ১৯৯৩ সালে মারা যান নিবারণ। মামলায় বাদী হিসেবে পক্ষভুক্ত হন নিবারণের ছেলে লক্ষ্মণ প্রামাণিক ও পরেশ প্রামাণিক। মামলার শুনানি শেষে ১৯৯৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি তৎকালীন সাবজজ আদালত নিবারণের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নিজের কেনা ৯৮ শতাংশ সম্পত্তি ফিরে পেতে জজ আদালতে আপিল করেন আব্দুল জলিল। আপিল আংশিক মঞ্জুর করে ২০০০ সালের ২৭শে এপ্রিল রায় দেন আদালত। রায়ে আদালত বলেন, ৪৯ শতাংশ সম্পত্তির স্বত্ব ভাগ্নে গৌর চন্দ্র মণ্ডলের। এই ৪৯ শতাংশ তিনি বিনিময় করতে পারেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষই ২০০০ সালে হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। ২০১৪ সালের ৩রা জুন হাইকোর্ট রুল খারিজ করে রায় দেন। অর্থাৎ জজ আদালতের দেয়া সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। এর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে আপিল বিভাগে আবেদন করেন লক্ষ্মণ প্রামাণিক ও তার ভাই পরেশ প্রামাণিক। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ২৩শে অক্টোবর আপিল বিভাগ মামলাটি হাইকোর্টে পুনঃশুনানির জন্য পাঠান। বর্তমানে মামলাটি বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চে বিচারাধীন। গত ২০শে সেপ্টেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য ৩৮ নম্বর ক্রমিকে ছিল। কিন্তু এর আগে সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৯২ বছর বয়সী লক্ষ্মণ প্রামাণিক মারা গেছেন বলে স্বজনরা জানান। আদালত লক্ষ্মণ প্রামাণিকের ওয়ারিশগণকে পক্ষভুক্ত করার নির্দেশ দেন।

অন্য খবর  শেষ হলো নুরুল্লাহপুর ফকির বাড়ির হাওয়াই শিন্নি

এভাবেই বছরের পর বছর যায়। কিন্তু মামলা শেষ হয় না। এক সময়  বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হয়ে রায়ের আশা ছেড়ে দেন। একপর্যায়ে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন আইনজীবীর সঙ্গে। তবে এমন ঘটনা শুধু সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গেই ঘটে তা কিন্তু নয়। আইনজীবীর নিজের মামলাতেও এমন ঘটনা ঘটে।  ফলে, কয়েক যুগ পার হলেও মামলা শেষ হয় না। ঢাকা জজ কোর্টে স্বয়ং আইনজীবীর মামলায় ২০ বছরেও মামলাটি এখন যুগ্ম জেলা জজ ও পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। গতকাল মামলাটি যুক্তিতর্ক ও দরখাস্ত শুনানির জন্য ছিল। এই মামলার বাদী-বিবাদী চারজন মারা গেছেন। বর্তমানে মামলার পক্ষভুক্ত হয়েছেন উভয় পক্ষের ওয়ারিশগণ। কবে মামলাটি শেষ হবে? সঠিকভাবে বলা যায় না। তবে  জজ কোর্টে রায় হলে যে পক্ষেই রায় যাক না কেন, উভয় পক্ষই হাইকোর্টে আপিল করবে। ওখানেও বেশ কয়েক বছর সময় লাগবে। এরপর মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন। তিনি বলেন, ক্লায়েন্টরা মনে করেন আইনজীবীরা ইচ্ছা করেই মামলা শেষ করেন না। অথচ তারা বুঝতে চান না আইনজীবীর মামলাও বছরের পর বছর লেগে যায়। মামলা শেষ হয় না। তিনি জানান, ২০০০ সালে আমার পিতা ও চাচারা বাদী হয়ে ১০১ শতাংশ জমির স্বত্ব ও খাস দখল পুনঃউদ্ধারে মামলা দায়ের করেন। ইতিমধ্যে বাদীপক্ষের দুইজন মারা গেছেন। বিবাদী পক্ষেরও দুইজন মারা গেছেন। কিন্তু এখনো মামলাটি শেষ হয়নি। মোকদ্দমাটি শেষ না হওয়া প্রসঙ্গে এডভোকেট শ্রেষ্ঠ আহমেদ রতন বলেন, একটি আদালত প্রতিদিন ৪-৫টি মামলার শুনানি করেন। কেননা, তার অধীনে প্রতিদিন মামলা থাকে শতাধিকেরও বেশি। পরিতাপের বিষয় হলো, এই মামলার বাদী আমার দাদী আকলিমা বেগম মামলার রায় না দেখেই ইন্তেকাল করেছেন। নথি থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে বসতবাড়ির জমি উদ্ধারে ঢাকার ৫ম সাবজজ (যুগ্ম জেলা জজ) আদালতে মামলা করেন। এখন পর্যন্ত বাদীপক্ষের মাত্র দুজনের সাক্ষী জেরা শেষ হয়েছে। ইতিমধ্যে ১ জন বাদী আকলিমা বেগম ও তিন বিবাদী জোনাব আলী, মোন্নাফ ও নাসির উদ্দিন ইন্তেকাল করেছেন। এখন পর্যন্ত এই মামলায় বেশ কয়েকজন আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু কারো পক্ষেই মামলা শেষ করা সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ মামলাটি শেষ হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি মামলার তারিখ পড়ে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস পর। এরমধ্যে আবার মামলার কার্যতালিকায় অনেক মামলা থাকায় আদালত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশি সময় দিতে পারেন না।

আপনার মতামত দিন