ফেসবুক ব্যবহারকারীর বয়স কত হওয়া উচিত?

686

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীর বয়স আসলে কত হওয়া উচিত? ১৩, ১৬ নাকি ১৮? সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে এমন একটি প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে।  ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৩ বছরের নিচে কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবেন না। ইউরোপীয় কাউন্সিল প্রস্তাব করেছে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর বয়স ১৩-এর মধ্যে হওয়া উচিত। এদিকে, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলছে, ১৬ বছর। যদিও এই ১৬ বছর বয়স নিয়ে পার্লামেন্টে বিস্তর বাহাসও হয়েছে কিন্তু ১৩ না ১৬? তা পাস হয়নি।

এদিকে, আমাদের দেশে ফেসবুক ব্যবহারের নির্দিষ্ট কোনও বয়স নেই। ফেসবুকের ওই বেঁধে দেওয়া বয়সকেই নিয়ম বলে মানা হচ্ছে। তবে, ঠিক কত বয়স হলে তা ঠিক মানদণ্ড হবে, এমন সিদ্ধান্ত কেউ দিতে পারেননি। এ-ও নির্দিষ্ট হওয়া যায়নি, ফেসবুক ব্যবহারের জন্য আদৌও কোনও সুনির্দিষ্ট করা উচিত কি না। এই প্রতিবেদন লেখার আগে দেশের বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, গবেষক, শিক্ষক, উন্নয়নকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা একেকজন একেক রকম মত দিয়েছেন। সুনির্দিষ্ট একটি বয়সকে কেউ চিহ্নিত করেননি।

এই যেমন বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার মনে করেন, যে বয়স থেকে কেউ মাউস চালাতে পারেন, বা টাচস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন এবং নিজেকে নিরাপদ রাখার যোগ্যতা রাখেন, সেই বয়স থেকেই ফেসবুক ব্যবহার করা উচিত। এখানে শারীরিক বয়সটা মোটেই মুখ্য নয়।

উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আমাদের গ্রামের প্রকল্প পরিচালক রেজা সেলিম বলেন, বয়স ১৮ বছর হওয়ায় ভালো।  আমি মনে করি, ফেসবুক ব্যবহারের বয়স ১৮-এর নিচে হওয়া উচিত হবে না।  উন্নত বিশ্বের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, সেসব দেশে আরও কম বয়সের শিশুরা ফেসবুক ব্যবহার করে, আমাদের দেশে তা অনুসরণ করা ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওইসব দেশের শিশুদের ধ্যানধারণা, শিক্ষা, দায়িত্বশীলতা আলাদা। আমাদের শিশুরা ওদের থেকে অনেক পিছিয়ে। আমাদের শিশুদের সবকিছু বুঝতে, শুনতে, জানতে অনেক সময় লেগে যায়। এ কারণে ১৮ বছর বয়সই উত্তম।

প্রসঙ্গত, দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি। যদিও এর মধ্যে বেশিরভাগ আইডি ফেক বা ভুয়া।১৩ বছরের নিচে ফেসবুকে আইডি খোলার নিষেধ থাকলেও দেশে অনেক শিশুর নামে ফেসবুক আইডি দেখা যায়।

অন্য খবর  ফেসবুক থেকে উঠে যাচ্ছে লাইক অপশন

শ্রীলংকাভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সায়ীদ খান মনে করেন, এটা একান্তই বাবা-মায়ের ব্যাপার। সন্তানের বাবা-মা যখন উপযুক্ত মনে করবেন, তখনই তার সন্তানকে ফেসবুক ব্যবহার করতে দেবেন। এক্ষেত্রে তিনি পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি নজর না দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ তাদের ধ্যান-ধারণা, শিক্ষা, রুচি, সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের মতো নয়। ফলে কে কী করল তা না দেখে, বিচার না করে নিজেদের মতো করেই এগোনো উচিত।

বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, ফেসবুক ব্যবহারের জন্য ১৩ বছর বয়সই উপযুক্ত সময়। তার ধারণা, দেখা যাবে ১৩ বছর বয়সীরা আজকাল অনেক কিছু জানে, আবার ৩৩ বছরের একজন হয়তো কিছুই জানে না। ফলে বয়স কোনও ম্যাটার করে না। আমার দৃষ্টিতে ১৩ বছরইজ ফাইন। তিনি বলেন, যেসব দেশের নিজস্ব কনটেন্ট আছে, সেসব দেশে ফেসবুক ততটা জনপ্রিয় নয়। আমাদের সমস্যা হলো আমাদের নিজস্ব কোনও কনটেন্ট নেই। তাহলে আমাদের সন্তানেরা কি করবে- প্রশ্ন করেন তিনি।

মুনির হাসান বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন প্রায় ১৪০ কোটি মানুষের দেশে ফেসবুক নিয়ে কোনও মাতামাতি নেই। সেখানে জনপ্রিয় হলো টুইটার। আমাদের দেশে ততটা নয়, কারণ আমরা কম কথায় কিছু বলতে পারি না। আমাদের রচনা লেখা ছাড়া কোনও উপায় নেই যেন। তিনি মনে করেন, যতদিন না আমরা নিজস্ব (স্থানীয়) কনটেন্টে সম্মৃদ্ধ হতে পারব ততদিন আমাদের ফেসবুক নির্ভরতা কমবে না।

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুস্তফা হোসেইন মনে করেন, যে বয়সে একজন মানুষ ফেসবুকটা ভালোভাবে জানতে এবং বুঝতে পারবেন, সেই বয়স থেকেই সে ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে। তবে তিনি এ-ও মনে করেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য ফেসবুক ব্যবহারের আদর্শ সময় নবম-দশম শ্রেণিতে পড়াকালে। এ সময় তারা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, পড়াশোনার বিষয়ে খোঁজ-খবর করবে। তবে এ বিষয়ে তিনি বাবা-মায়েদের সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তাদের সন্তানরা ফেসবুকে ক্ষতিকর কিছু করছে কি না—সেসব মনিটরিং করতে হবে। ছেলে বা মেয়ে চেয়েছে বলে ফেসবুক দিয়ে দিলাম, মোটেও তা হওয়া উচিত নয়।

অন্য খবর  ইন্টারনেট ছাড়াই ফেসবুক

একজন সরকারি চাকরিজীবী আবেদা সুলতানা বলেন, ফেসবুক পড়াশোনার ক্ষতি করে। তাই পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরই ফেসবুকে ঢোকা উচিত। বয়স বিবেচনায় ২৫ উপযুক্ত সময় বলে আমি মনে করি।

এদিকে, শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে ইউনিসেফ, টেলিনর গ্রুপ ও মোবাইলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন একটি অভিভাবক গাইড প্রকাশ করেছে। গাইডটিতে শিশুদের সঙ্গে কিভাবে ইন্টারনেট নিয়ে কথা বলবেন সে বিষয়ে পরামর্শ এবং দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

অভিভাবক গাইডটিতে ফেসবুক, ইউটিউব, স্যাট্টুলেট, আস্ক এফএম, ইন্সটাগ্রাম, টিনডার, ভক্সার, ইক ইয়াক, হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট, ভাইন, কিক মেসেঞ্জার, শটস অব মি অ্যাপ ও ওয়েবসাইট সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন (বয়সসীমা সংক্রান্ত নিয়মাবলী দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করা) থাকারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আপনার সন্তান সঠিক ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সঠিক ট্র্যাকে আছে কিনা তা-ও পর্যবেক্ষণ করা বলা হয়েছে। তারা শুধু প্রযুক্তিই ব্যবহার করে না, প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ কোনও জ্ঞান রাখে কি না—সে বিষয়েও বাবা-মাকে খোঁজ নিতে হবে। গাইডে দেওয়া হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে কারও সঙ্গে তর্ক করা, কোনও পোস্ট দেওয়া, সেই পোস্ট পরে ডিলিট করা, অনলাইনে গেম খেলার সময় কারও মৌখিক আক্রমণের শিকার হওয়া, কোনও কুৎসা রটানো, কাউকে ব্লক করা হয়েছে কি না–এই ধরনের প্রশ্ন করে উত্তর বের করে নিয়ে আলোচনা করলেই বেরিয়ে আসবে আপনার সন্তান অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছে কি না। কিভাবে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরাপদে থাকা যায় সেসব কৌশলও গাইডটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আপনার মতামত দিন