স্মৃতিতে উজ্জ্বল আজও তাহার মুখ (প্রয়াত সৈয়দ স্যার)

1151

১৮ ই নভেম্বর ২০১৫। নয় বছর আগে ২০০৬ সালের এই দিন দোহার থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলী মিয়া (সৈয়দ মাস্টার) এ পৃথিবীর সব মায়া ছেড়ে হাজারও মানুষকে কাঁদিয়ে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে স্থায়ী বসবাসের জন চলে গেছে। স্যারের চলে যাওয়া আমার মনোজগতে সারা জীবনের পোস্টার হয়ে সেঁটে আছে। আমার সামনে এ পৃথিবীর সব কোলাহল অর্থহীন, সব আলো নিভে গিয়েছিল তখন। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। ফোন করলে স্যার আগে জিজ্ঞেস করতেন কবে বাড়ী আসবি? আমি বলতাম কিছু দিনের মধ্যেই আসব। বাড়ী ঠিকই গিয়েছিলাম কিন্তু স্যারের মুখের বানী শোনতে পাই নাই। শুধু তার কবরের পানে তাকিয়ে থেকে দু’চোখের প্রান্ত থেকে ক’ফোঁটা অশ্রু ঝরাতে পেরেছি এ টুকুই শান্তনা।

স্যারের মৃত্যুতে আমি একজন নির্ভরযোগ্য অবিভাবক হারিয়েছি, একজন হিতাকাঙ্খী হারিয়েছি, সুখ-দুঃখের সান্তনা হারিয়েছি। যার কাছ থেকে নিজকে সংশোধনের অনেক উপকরণ পেয়েছি। তার হঠাৎ চলে যাওয়া তাই সহজেই মেনে নিতে পারি নি । কিন্তু বিধাতার বিধানের উপর তো কারো কিছু করার নেই। স্যারের চলে যাওয়ায় এমন কোনো সাধারণ মানুষ নেই, যিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন নি। কেউ কেঁদেছেন, কেউ কষ্ট বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই মানসিক বিপর্যয়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেছেন। মর্মান্তিক, দুঃখজনক, হতাশাব্যঞ্জক পরিবেশ চারপাশকে গুমোট করে রেখেছে দীর্ঘদিন।

যতদিন দেশে ছিলাম তাঁর কাছে এলে পাওয়া যেত বৃক্ষের ছায়া, পুষ্পের ছোঁয়া, অপত্য স্নেহমাখা হাসির ঝিলিকে প্রাণ হতো চঞ্চল, কথার জাদুমালা নিবিষ্ট শ্রোতায় পরিণত করত, জীবনের নানা বিষয়ে পাওয়া যেত সুপরামর্শ, বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে পাড়ি দেওয়া যেত সাঁকো কিংবা মিলত অভিভাবকত্বের অসীম স্নেহাবিষ্ট মুখ। তিনি ছিলেন আত্মার আত্মীয়। আলোকের ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দিতে চাইতেন সব অন্ধকার, কুসংস্কার আর অজ্ঞতা। সুদর্শন, সুশোভন সৈয়দ স্যারকে যতবারই দেখেছি, ততবারই নতুন করে প্রাণ পেয়েছি। স্বপ্ন দেখার সিঁড়ি শুধু খোঁজা নয়, তা সত্যি করার নিরলস প্রয়াস রেখেছেন সান্নিধ্যজনের জন্যও। তাঁর সান্নিধ্য জ্ঞানের পরিধি বাড়াত।

রাজনীতিতেও ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় অংশ গ্রহন করেছেন। সংগঠন করেছেন শান্তির জন্য। আড্ডা বা আলোচনায় নানা বিষয় এসে জড়ো হতো। বিশ্বপাঠশালার ছাত্রের মতো কত অজানাকে যে তুলে ধরতেন, কত অচেনাকে চেনাতেন, অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানা ঘটনার সারি। শিক্ষক সুলভতায় নয়, বন্ধুবৎসলতায় রেখেছেন নৈকট্যে; উদ্দীপ্ত করেছেন সৃষ্টিশীলতায় নিমগ্ন হতে। বয়স কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় নি বলেই সান্নিধ্যে, নৈকট্যে যাওয়ার ক্ষেত্রে সংকোচ বা জড়তা এসে ধরা দিত না। বন্ধুর মতো, স্বজনের মতো দ্রবীভূত করে দিতেন তরুণ, অতি তরুণকেও। তারুণ্যের আবেগকে কখনো দমাতে চান নি, বরং তাদের সান্নিধ্য পেতে কখনো বেগ পেতে হতো না। ব্যক্তিজীবনের সমস্যা অকপটে বলা যেত, মিলে যেত সমাধানও। সব ধর্ম বর্ণ ও পেশার মানুষের সাথে মিশত অবলীলায়। মুক্তবুদ্ধির মানুষ বলেই মানুষ তাঁর কাছে পেত মর্যাদা। কর্মের মধ্যে যে মানুষের মুক্তি নিহিত আছে, সেই উপলব্ধিটুকুও তাঁরই সহজাত।

অন্য খবর  যেভাবে ৩০ মে হত্যা করা হয় জিয়াউর রহমানকে

নির্ভীক শিক্ষক সৈয়দ স্যার আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সৈয়দ কাকা কখনো অমরত্বের সাধনা করেন নি। তাই তাঁর অনুপস্থিতি বড় বেশি বেদনার, বিষাদের। এমনই মানুষ ছিলেন তিনি, যাঁর সান্নিধ্য কখনো পরিণত হয়নি অভিমান, ভারবাহী কিংবা বিষাদে। বরং ব্যস্ত মানবের সান্নিধ্যের সময়টুকু কেড়ে নেওয়াও কম দুষ্কর ছিল না। তাঁর সান্নিধ্য, নৈকট্য এক গৌরবময় অধ্যায়, জীবনের পরমতম প্রাপ্তি। অভিভূত করে রেখেছিলেন আমাকে, যত দিন কাছে ও দূরে ছিলাম। আজ তিনি নেই কিন্তু তার উপস্থিতি যেন আমার সারা দেহ মন জুড়ে। দেশে থাকতে, যখন তিনি জীবিত ছিলেন কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমার ডাক পড়ত, কারণ আমার মোটর সাইকেলের পিছনে বসতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তাকে নিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক প্রয়োজনে দোহার নবাবগঞ্জ থানার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রয়োজনে ফরিদপুরের সদরপুর ও চরভদ্রাসনে ছিল অবাধ বিচরণ।

একজন আদর্শবান, নির্লোভ, নির্মোহ ও নিরহংকার মানব ছিলেন সৈয়দ স্যার। ৯৬-এ দল ক্ষমতায় থাকতেও সভাপতি ছিলেন তিনি। তার পরিবারে কোথাও বিত্ত-বৈভব বিলাসিতার চিহ্ন নেই। তিনি সাধারণ আসবাবপত্রে অতি সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। তার আশে পাশে যারা ছিল তাদের বিরোদ্ধেও হাটবাজার দখল, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, অন্যের জমি দখল, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ছিল না। তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজনীতিতেও পেয়েছিলেন ত্যাগী মানুষদের সংস্পর্শ।

বাঙালির জীবনযাপনের যে আবহ, সৈয়দ স্যার তাতেও ছিলেন একনিষ্ঠ। অতি নাগরিকতা তাঁকে টানে নি বলেই চিরায়ত বাংলার রূপটুকু ধরে রাখতে চেয়েছেন সব সময়। পদ্মার চরে নতুন পলি জমে উর্বর ধানি জমি তৈরী হলে সকল প্রভাবশালীদেরই নজর থাকে সেই চরের প্রতি কিন্তু তিনি প্রভাবশালী হওয়া সত্বেও কখনো প্রভাব বিস্তার করেন নি। নিজে উপস্থিত থেকে যার যার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতেন। গ্রামীণ জীবন, সমাজ ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধের তীব্রতা ধরা পড়ত তাঁর কথা ও কর্মে। সব মতামতকেই গুরুত্ব দিতেন। নিজস্ব মতামত কখনো চাপিয়ে দিতেন না। তবে তাঁর যুক্তি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াত যে তাঁর মতামতটিই হতো সঠিক। আধুনিক, রুচিমান ও বিশুদ্ধ মানবের প্রতিকৃতি মিলত তাঁরই মধ্যে।

নিষ্ঠা তাঁকে শিখরে পৌঁছিয়েছে। নানা বিষয়ে আগ্রহ, দূরদর্শিতা এসবই অনুপ্রাণিত করত সান্নিধ্যজনকে। মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা, মানবকল্যাণ ধারণ করে সম্পন্ন মানবে পরিণত সৈয়দ স্যার যে আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে গেছেন, তাঁর অবর্তমানে তা প্রজ্বালিত রাখার দুরূহ দায়িত্ব অবলীলায় বর্তে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। যতদিন বেঁচেছিলেন নিজ বিদ্যালয় জয়পাড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস এবং নিজ বাড়ীর আঙ্গিনা আম তলায় বসে কাটাতেন অবসরের সময়টুকু। এই আমতলায় বসেই দোহার থানার জনসাধারনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতেন।

অন্য খবর  গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগ, কয়েকজনকে অর্থদন্ড

তিনি ছিলেন একরোখা যা বলতেন তা করতে কখনো পিছ পা হতেন না। তার দৃঢ়তা যত দেখছি ততবারই মুগ্ধ হয়েছি। আমার রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে সৈয়দ স্যারের স্নেহের সানিধ্যে। তাই তার স্নেহ মাখা হাতের ষ্পর্শ এখনও অনুভব করি এই প্রবাসে। অনেক সময় আমার কাছে প্রশ্ন করে বিভিন্ন ব্যাপারে মতামতও জানতে চাইতেন। স্যারের সাথে ভ্রমণকালে সফরসঙ্গী হিসেবে দেখেছি মোহমুগ্ধতায় তাঁকে প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে। সবাইকে আপন করে নেবার একটা অসসম্ভব শক্তি ছিল তার ভিতর।

১৯৪৫ সালের ১ লা জুলাই জন্ম নেওয়া অকুতোভয় সৈয়দ স্যার অপত্যস্নেহ আর ভালোবাসায় সিক্ত করে গেছেন স্বজন, অনুরাগী ও গুণমুগ্ধদের। সাধারন মানুষের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র টান। তার সাথে বিভিন্ন সময় ভ্রমণের সঙ্গী হিসেবে দেখেছি, যেখানেই যেতেন সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির খোজ খবরের পাশাপাশি সাধারন মানুষের খোঁজও নিতেন। আধুনিকতায় এবং বাঙালিয়ানায় সমৃদ্ধ মানুষটি আমাদের অন্তরাত্মায় গভীরভাবে ঠাঁই করে নিয়েছেন। ২০০৬ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও আমাদের নিত্যদিনের জীবনে পাথেয় হয়েই থাকবেন।

সীমার মাঝে অসীম হয়ে সৈয়দ স্যার বেঁচে থাকবেন তাঁর শ্রম ও কর্মের ফসলে। মৃত্যুও কখনও কখনও পরাজিত হয় বিশেষ করে যখন মানুষ মৃত্যুর পরও উজ্জ্বল থাকে, দীপ্যমান থাকে। তিনি মৃত্যুকে হারিয়েছেন। তার কর্মময় জীবন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, অতুলনীয় জীবনবোধ মৃত্যুকে পরাজিত করে আজো জ্বলজ্বল করছে দোহারের মানুষের কাছে। তিনি ছিলেন এবং থাকবেন। তাই তো তার মৃত্যু একটা শারীরিক বিচ্ছেদ মাত্র, তার ভালোবাসার উত্তরাধিকারদের কাছে এর চেয়ে আর কিছুই নয়। আগামী দিনগুলোয় আরও বেশি অনুভূত হবে তার শূন্যতা। তার শূন্যতা পূরণের দায়িত্ব এখন তারই যোগ্য উত্তরসুরী তারই মতো সৎ আদর্শের প্রতীক সাজ্জাদ হোসেন সুরুজের উপর। তার অসমাপ্ত কাজ তাকেই পুরন করতে হবে। তাই আসছে দোহার পৌরসভা নিবাচনে প্রাথী হবার মনস্থির করেছেন। সৈয়দ স্যারের চলে যাওয়া যেন একটি ইতিহাসের চলে যাওয়া। একজন চিরউদ্যমী, সৎসাহসী, গণমানুষের বন্ধু, যুক্তিবাদী, মানবপ্রেমী ও মেধাবী সৃজনশীল চেতনাবোধের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে সৈয়দ স্যার ছিলেন একজন বড়মাপের মানবতাবাদী, উদাররাজনৈতিক ও প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক মানুষ। তিনি যেমন ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন তেমনি ছিলেন দোহারের মাটি ও মানুষের প্রতি যত্মশীল দায়িত্বসম্পন্ন। দোহারের জনগনকে ভালোবাসতেন অকৃত্রিম আত্মত্যাগী আদর্শিক নিষ্ঠায়। তিনি চলে গেলেও তাকে দোহারের জনগন মনে রেখেছে আপন মহিমায়। তিনি আমার তথা দোহারের গনমানুষের হৃদয়ের পটভূমির লাল সূর্যটির মতো জ্বলজ্বলে সূর্য হয়ে জেগে থাকবেন দোহারের পথে-প্রান্তরে আর আমার মনোমন্দিরের বিশাল ক্যানভাস জুড়ে। আজ দোহারের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তার বড় বেশি প্রয়োজন ছিল।

লেখক:
হামিদুর রহমান পলাশ
সাবেক ছাত্রনেতা
যুগ্ন আহ্ববায়হ, দোহার পৌরসভা কৃষকলীগ।

আপনার মতামত দিন