চাকরি করিনি বলেই লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান করেছি: নূর আলী

 

কালকে পরীক্ষা। পরীক্ষার পড়া পড়তেছি; কিন্তু রাত সাড়ে ৮টার দিকে দেখি কুপির (প্রদীপ) আলো নিভে আসছে। তেল নেই। মায়ের কাছে ছুটে যাই। মা বললেন ‘তোমাকে তো বললাম স্কুলে যাওয়ার সময় তেল নিয়ে এসো।’ বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ছিল বাজার। কুপির আলোয় আমার পড়া আর শেষ হয়নি; কিন্তু সেদিন ছিল পূর্ণিমার আলো। বাইরে গিয়ে চাঁদের আলোয় পরীক্ষার পড়া পড়েছি। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছি। চাকরির দিকে না গিয়ে ব্যবসা করে সফল হয়েছি। চাকরি করিনি বলে আজ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করেছি। তোমরাও স্বপ্ন দেখো। বড় কিছুর স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখতে টাকা লাগে না। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পিতৃ হারানো এক শিশুর কষ্টসাগর পাড়ি দেওয়া অতঃপর স্বপ্নসিঁড়িতে পা রাখা মানুষের জীবনের গল্প এটি। তিনি স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহা. নূর আলী।

জীবনের বাঁকে বাঁকে তৈরি হওয়া বর্ণাঢ্য গল্প থেকে স্বপ্নসিঁড়িতে উঠে আসার গল্প আজকের শিশু-কিশোরদের শোনালেন মোহা. নূর আলী। গতকাল শনিবার ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের ‘নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ’-এর বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও মেধা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান-২০১৬ আয়োজন করা হয়। নূপুরের তালে তালে স্কুলছাত্রীদের মনোমুগ্ধকর নৃত্য, গান, অতিথি-বক্তাদের আশা-আকাক্সক্ষার বর্ণনা, হাস্যরসভরা গল্প আর সেরা শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার হিসেবে বই বিতরণের মধ্য দিয়ে সকাল ১০টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে পুরো অনুষ্ঠান। মোহা. নূর আলী ১১১ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি।

উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজারো শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব ও আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই স্বপ্ন গড়ার এ কারিগরের বাস্তবজীবন নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য, গল্প আর শীর্ষে উঠে আসার কৌশল শুনে কখনো পুলকিত হয়ে ওঠেন আবার কখনোবা মনের অজান্তেই ফেলেছেন চোখের জল। নবাবগঞ্জের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া, তারুণ্যকে সঠিক গন্তব্যে এগিয়ে নিতে সহায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, পাইলট স্কুলের শিক্ষার গুণগত মানে শ্রেষ্ঠত্ব আর অবকাঠামোগত উন্নয়নে অবদান রাখা এ ব্যক্তিত্বের জন্য সকালের ঘন কুয়াশা আর হিমশীত উপেক্ষা করে অপেক্ষা করছিলেন যারা, তিনি উপস্থিত হলে তারা ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ছয় মাস আড়িয়াল বিলের অথৈ পানিতে অবরুদ্ধ আর বাকিটা সময় হেঁটে মেঠোপথ পাড়ি দেওয়ার অতীত স্মৃতি টেনে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে মোহা. নূর আলী বলেন, লুঙ্গি পরে পার্শ¦বর্তী কামারখোলা থেকে কোষা নৌকায় আড়িয়াল বিল ডিঙিয়ে ৫ কিলোমিটার ঘুরে স্কুলে যেতাম। আসা-যাওয়ায় দুই ঘণ্টা লাগত। তোমাদের সেই কষ্ট তো নেই। সুতরাং তোমাদের চিন্তা করতে হবে অনেক দূরের, তোমাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্নে দেখার এখনই সময়। তোমাদের মধ্যে প্রতিভা আছে, তার বিকাশ ঘটাতে হবে।

অন্য খবর  দোহারে সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল ছাত্রী নিহত

স্বপ্ন দেখা, স্বপ্ন আঁকা ও বাস্তবে তার রূপ দিতে বিশ্বাসী এ ব্যবসায়ী জ্ঞানপিপাসু কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বলেন, তোমরাই পারবে আমাদের স্থানে আসতে। আমরা তো একদিন থাকব না। তোমরা দেশকে নেতৃত্ব দেবে। রাজনীতি করবে। বড় ব্যবসায়ী হবে। চাকরিজীবী হবে। আমলা হবে। প্রকৌশলী-চিকিৎসক হবে। আর এসব হতে এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। স্বপ্ন না দেখে হঠাৎ করে কোনো কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। ছোটকালে অভাব আমাকে পরিকল্পনা করতে শিখিয়েছে। যাদের অভাব বেশি, তাদের পরিকল্পনাও বেশি। আমি মনে করি তোমরা মাঝামাঝি পর্যায়ে আছ। তোমাদেরই পরিকল্পনা করার সময়। এখন যারা রাষ্ট্রের শীর্ষে, তারা তো একদিন থাকবেন না। তোমরাই ওই জায়গা পূরণ করবে।

জ্যেষ্ঠ শিক্ষক সুধীর চক্রবর্তীর সঞ্চালনায় সুবিশাল মাঠের শামিয়ানা ঘেরা অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে মগ্ন শ্রোতা বা শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন শিক্ষানুরাগী মোহা. নূর আলী। উৎসুক শিক্ষার্থীরাও অবলীলায় তার জবাব দিয়েছে। এ সময় নূর আলী বলেন, আগে শুনতাম কাল তিন প্রকার। কিন্তু পৃথিবীতে এখন একটিমাত্র কাল রয়েছে। তা ‘বর্তমান কাল’। আগামীকাল তুমি বাঁচলে কিছু করতে পারবে। আজকের কথা ভেবে অবশ্যই ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। তিনি বলেন, একটা মানুষের ২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত শেখার সময়। ১৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত আস্তে আস্তে এটা কমে আসে। ১৫ বছর পর্যন্ত যা করলে সারা জীবন এটিই বহন করতে হবে। জীবন গঠনের সময় ছাত্রজীবন। গঠন ভালো হলে কর্মজীবন ভালো থাকবে। কর্মজীবনে ভালো না হলে অবসর জীবনেও শান্তি থাকে না। এটাও ছাত্রজীবনে শিক্ষা নেওয়ার উপযুক্ত সময়। ভালো ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি একজন ভালো মানুষ হতে হবে। আমাদের ভালো মানুষ বড় দরকার। কারণ আমাদের সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ একটা বলে, আরেকটা করে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজমুন আখতার এবং দুই শিক্ষার্থী বক্তব্যে মোহা. নূর আলীর কাছে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজকে জাতীয়করণ এবং জরাজীর্ণ ভবন সংস্কারের দাবি জানান। জবাবে নূর আলী বলেন, পুরনো ভবনের মান যাচাইয়ে আমি প্রকৌশলী পাঠাব। এরপর নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়টিও দেখা হবে। একই সঙ্গে জাতীয়করণের চেষ্টার কথাও জানান তিনি। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বায়রার মহাসচিব রুহুল আমিন তার নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে একটি কম্পিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন।

ঐতিহ্যবাহী স্কুল ও কলেজটি দিন দিন ফলে পিছিয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ করেন অভিভাবকরা। এ নিয়ে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে গ্রুপ বা দলভিত্তিক পাঠদানের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির পরামর্শও দেন সভাপতি। শিক্ষকের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রতি শিক্ষার্থীর দিকে নজর দিতে হবে। এখানে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া সুপারিশে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। টিউশনি ছাড়া আন্তরিকতা, টিমওয়ার্ক দিয়েই ক্লাসে সব পড়া আদায় করার ব্যবস্থা করতে হবে। যে শিক্ষকের পড়ানো ভালো হয়, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। যে শিক্ষকের বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করে তার শাস্তিও হবে।

অন্য খবর  নবাবগঞ্জ ইউএনও এর সরকারি নাম্বার ক্লোনের অভিযোগ

অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পাঠানো এক মায়ের করুণ চিঠি পড়ে শোনান নূর আলী। এ সময় শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অনেকেই কেঁদে ফেলেন। মোহা. নূর আলী বলেন, তোমরা যেন এমন সন্তান না হও। শিক্ষার্থীদের তিনি বলেন, তোমরা সচ্ছলভাবে লেখাপড়া করছ। বিপদ মোকাবিলা করতে পারবে না। আমি যত বিপদের মুখোমুখি হয়েছি, ততই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। জীবনে কারো কারণে কখনো কোনো কষ্ট পেলে এটা মাথায় রাখবে না। এটাকে প্রতিশোধ হিসেবে মাথায় নেবে না।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ একাত্তরের সব শহীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ার স্মৃতি স্মরণ করে মোহা. নূর আলী বলেন, তখন আমি চুরাইন স্কুলে ক্লাস নাইনের স্টুডেন্ট। পাইলট স্কুলে মিছিল নিয়ে আসি। তখন ক্লাস চলছিল। অনেক চেষ্টা করি এ ¯ু‹লের ছাত্রদের মিছিলে নামাতে; কিন্তু পারিনি। তখন দেয়াল টপকে, বেল পিটিয়ে ছাত্রদের বের করেছিলাম। স্বাধীনতার পাঁচ স্তম্ভের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, স্বাধীনতা মানে ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর মতো একজন লিডার। বঙ্গবন্ধু নেই, তার কন্যা জননেত্রী একাত্তরের ঘাতক, লুটেরাদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। অনুরোধ করব যত কষ্টেই হোক এই বিচার শেষ করা হোক। এজন্য সরকার বা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিচ্ছি।

অনুষ্ঠানে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি বেনজীর আহমদ, বায়রার সাবেক সভাপতি ও রোটারি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক গভর্নর এফএফ গোলাম মোস্তফা, বায়রার মহাসচিব মো. রুহুল আমিন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাজী শওকত হোসেন শাহীন, নবাবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহম্মেদ ঝিলু, গুলশান জগার্স ক্লাবের সদস্য মাহফুজ জলিল, নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সাবেক সভাপতি মো. ফিরোজ আলী, প্রান্তিক ট্রাভেলসের পরিচালক রাকিব মোস্তফা, ওসি মোস্তফা কামাল, দোহার-নবাবগঞ্জ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মানবেন্দ্র দত্ত, আদর্শ ডিগ্রি (অনার্স) কলেজের অধ্যক্ষ আজিজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ দারু, শিকারীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আলীমুর রহমান খান পিয়ারা, মো. জসিম উদ্দিন, দুলাল হালদার, উপজেলা যুবলীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক মশফিকুর রহমান পলাশ, নবাবগঞ্জ উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আবুল কালাম আজাদ, বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির দাতাসদস্য হাজী সোয়ায়েব মিয়া, মাধ্যমিক সদস্য বজলুর রশীদ, মোয়াজ্জেম হোসেন, শিক্ষক প্রতিনিধি রোকসানা আক্তার, সংরক্ষিত সদস্য সানজিদা কবির, অভিভাবক প্রতিনিধি শেখ নাঈম আহমেদ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজমুন আখতার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আপনার মতামত দিন