ইছামতির বাঁচার আকুতি

720
বান্দুরা সেতু থেকে ইছামতি নদী, নবাবগঞ্জ

রাশিম মোল্লা : ওগো তোমরা কে কোথায় আছো? সবাই কি ঘুমিয়ে আছো? নাকি জেগে জেগে ঘুমের ভান করছো? তোমরা কেউ কি আমার ডাক শুনছো না? তোমরা কি সকলেই বধির? বোবা হয়ে গেছো? আমি বড়ই তৃষ্ণার্ত, বড়ই ক্লান্ত, আমাকে একটু পানি দেবে? তিন যুগ পরে ঘুম থেকে জেগে তোমাদের ডাকছি……. কিন্তু তোমরা তো শুনছো না? কেন তোমরা আমার আর্তনাদ শুনছো না? আমার কি অপরাধ? দোহার-নবাবগঞ্জের কার্তিকপুরের ইছামতি নদীর এমন আর্তনাদ ফুটে উঠেছে দোহার গ্রাজুয়েট সোসাইটির সাবেক সভাপতি আইয়ুব আলীর ফেসবুক টাইমলাইনে।

ওহ! বুজেছি তোমরা আমার সাথে অভিমান করেছো। আশির দশকে  আমার একটি হাত কার্তিকপুরে বেঁধে দিয়েছো। কিছুদিন যেতে না যেতেই ধুলশুরায় মাথাটা আটকে দিলা। এরপর আমার তন্দ্রার সুযোগে ডান হাতটাও’ ৯৮ এর পরে কাশিয়াখালী বেরিবাধে আটকে দেয়া হলো। আহা! আমি যে আজ জেগেও মৃত। কথা বলতে পারছি না। কেউ আমার দিকে তাকিয়েও তাকায় না, দেখেও না দেখার ভান করছে!

হ্যাঁ আমার ভরা যৌবনে সকলেই আমার কাছে আসতো আমাকে আদর করতো, আমার বুকে পাল তুলে নৌকায় যাতায়াত করতো, জেলে বন্ধুরা মাছ শিকার করতো। সৌখিন মাছ স্বীকারীরা দোয়াইর পারন পেতে ডিমওয়ালা চিংড়ি ও বাইলা মাছ ধরতো, অনেকে ঝাকি জাল দিয়ে কার্তিক মাসে আমার বুক ঝাঝড়া করে রুই, কাতল, টাটকিনি, কই, শিং মাছ ধরতো………..। নববধুরা  কেরাই নৌকায় স্বামীর বাড়ী থেকে বাপের বাড়ী যেত। ভাদ্র মাসে জোতদার মহাজনরা নৌকা বাইচের আয়োজন করতো, কলাকোপা, বান্দুরার মহাজনরা গয়না নৌকায় ঢাকা থেকে মালামাল আনতো, প্রতিদিন কাচারী ঘাট, বান্দুরা, বারুয়াখালী থেকে লঞ্চগুলো আমার বুক চৌচির করে সদরঘাটে আসা যাওয়া করতো…… আহা আমার যে কত ভাল লাগতো। সবাই আমাকে ভোগ করলেও কেউ কিন্তু আমার অনুমতি নিত না। ওখানেই ছিলো আমার আনন্দ। আজকের এই অনাদর আমার ভাল লাগে না। আমি যে আবার পুরনো জীবনেই ফিরে যেতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।  ইছামতির আকুতি কোথায় সালমান? কোথায় সালমা? কোথায় তোমরা? তোমরা যদি কার্তিকপুর, ধুলশুরা এবং কাশিয়াখালী বেরিবাঁধে স্লুইচ গেটের ব্যবস্থা করতে, তাহলে আমি আমার হারানো যৌবন ফিরে পেতাম………….. কারো কাছে জলের জন্য হাহাকার করতে হতো না। তোমাদের কি একটুও মায়া লাগে না? আমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমিও যে তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবো।

অন্য খবর  গরমে পুড়ছে দেশঃ দোহার – নবাবগঞ্জে তাপমাত্রা ৩৬º, গরম অনুভুত ৪৪º

সূত্র জানায়, এক সময় পদ্মার সাথে সংযোগ ছিলো কার্তিকপুরের ইছামতি নদীর। লঞ্চ, স্টিমার, বড় নৌকা যাতায়াত করতো। বড় বড় গয়নার নৌকা, নানান প্রকার পাল তোলা নৌকা পদ্ম নদী দিয়ে সহজেই কার্তিকপুরের ইছামতি নদী হয়ে ঢাকায় যাতায়াত কত। সড়ক পথের চেয়ে নৌবানিজ্য  আধিপত্ত ছিলো বেশি। কার্তিকপুরের এই স্পট ছাড়াও পদ্মা নদীর সাথে গালিমপুর, শ্রীনগর, লৌহজং,বোয়ালী- চেগারকোনা দিয়ে পদ্মার পানির সংযোগ ছিল। জোয়ারের সময় পানি আসতো, আবার ভাটার সময় কমে যেতো ইছামতির পানি। কালক্রমে অন্যান্য সংযোগ স্থলের মতো কার্তিকপুরও ইছামতি নদীর মাথায় বাঁধ দিয়ে পদ্মার সাথে ইছামতির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন পানি কমতে কমতে ইছামতি আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে। আশি দশকে ক্যাপিন্টন নুরুল হকের উদ্যোগে ইছামতি নদীর পূর্নজারণ পায়। কিন্তু সেই সংস্কার বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। ময়লা আর্বজনা ফেলে ইছামতিকে ভরাট করতে থাকে।  ইছামতির সাথে সংযুক্ত বড় বড় হাওর, খাল বিল, চক এর সংযোগ খালগুলোর উপর রাস্তা নির্মানের ফলে পানির উৎস সংকোচিত হয়ে আসছে।

কাশিয়াখালি বেরিবাধ রক্ষা মঞ্চের এডমিন রানা ভাইয়া বলেন, ইছামতিকে বাঁচাতে কাশিয়াখালী বেরিবাঁধ স্পট ও কার্তিকপুর স্পটকে বিবেচনায় করছেন এর সাথে সংশ্লিষ্টগণ।  কাশিয়াখালী বেরিবাঁধ থেকে পদ্মা বেশ দূরে সরে গিয়েছে। ইহাছাড়া বাধটি নির্মানের ফলে  প্রায় ২০ বছর নানাভাবে পরিবর্তন হয়েছে। এই স্পটে সুইন্স গেট নির্মাট করা হলে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। উল্লেখ্য  কাশিয়াখালী বেরিবাঁদে ছোট একটি  সুইন্স গেট রয়েছে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন এই সুইন্স গেট বর্ষা মৌসুমে পানি গতি বেশী থাকলেও শুস্ক মৌসুমে পানি থাকে না। অর্থাৎ বর্ষার তিন মাস এই সুইন্স গেট দিয়ে পানি পড়তে থাকে। বাকী সময় আর এই অঞ্চলটিতে পানি থাকে না।ইহাছাড়া খন্ডিত ইছামতির শেষ অংশে শুস্ক মৌসুমে পানি থাকে না। ঐ স্পটে পদ্মা নদীতেও পানিশূন্য হয়ে পড়ে।  এক সময় বোয়ালীর এই স্পটের সাথে পদ্মার সংযোগস্থল ছিলো। বর্তমানে পদ্মার এই অংশে চর জাগার ফলে মূল পদ্মা চলে গিয়েছে ধূলশুড়া ইউনিয়নের দিকে।  শুস্ক মৌসুমে ধূঁ ধূঁ পদ্মা বালু আর বালু ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। অর্থাৎ বর্ষার তিন মাস প্রচন্ত পানির চাপ থাকে। কিন্তু বাকী ৯ মাস পানিশূন্য হয়ে পড়ে।  সেইজন্য এই অঞ্চলটিতে সুইন্স গেট কোন উপকারে আসবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেনা। পক্ষান্তরে কার্তিক স্পটে পদ্মা নদী বেশী দূর না এবং এই স্পটে সবসময় পানি বিদ্যমান থাকে। এটিই হলো মূল পদ্মা। এই স্পটে সুইন্স গেট নির্মান করা হলে সাড়া বছর জুড়েই জোয়ার ভাটায় পানি আসা যাওয়া করতে পারবে। ফলে ইছামতির পানির নাব্যতা ফিরে পাবে। তাছাড়া এই অংশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও কম হবে বলে অনেকেই মনে করেন।

অন্য খবর  প্রিজমায় দোহার-নবাবগঞ্জের আকর্ষণীয় স্থানসমূহের ছবি

এদিকে এলাকাবাসী জানায়, ঢাকা -১ আসনের মাননীয় সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা জনাব সালমান এফ রহমানেরও প্রতিশ্রুতি ছিলো সুইন্স গেট নির্মানের। কার্তিকপুরে একটি সুইন্স গেট নির্মান করার সাথে যদি ইছামতিকে সংস্কার করে এর সংযোগ খালগুলো যদি উদ্ধার করা হয় তাহলে ফিরে পাবে ইছামতির প্রান। এর পাশাপাশি ময়লা আর্বজনা যাতে আর কেউ ফেলতে পারে সেইদিকে নজর দিতে হবে বেশী। আগামী দিনে ইছামতি সুরক্ষা করা একটি বিরাট চ্যালেন্জ। সেই দিক থেকে এই স্পটই হতে পারে সবচেয়ে বিবেচিত। প্রায় ৬৮ কিঃমিঃ দীর্ঘ এই নদীকে বাঁচাতে এর কোন বিকল্প নেই।

আপনার মতামত দিন