অন্তরালের নায়ক বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানঃ ভবিষ্যতের নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশ

381

বিজ্ঞানী জাহিদ হাসান: গ্রামের যে স্কুলে আমি পড়াশোনা করেছি, সে স্কুলে গেলাম। ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করলাম, তোমরা কী ফজলুর রহমান খানের নাম শুনেছ? ছেলেমেয়েরা শোনেনি। ফজলুর রহমানের নাম কেউই শোনেনি। বিষয়টা আমাকে বিস্মিত করেছে। কষ্ট পেয়েছি। আমি জানি না, আমাদের শিক্ষকেরা ক্লাসে গিয়ে কী গল্প করেন। কিশোর-কিশোরীদের কাছে কাদের গল্প শোনান? জাতীয় পাঠ্যবইয়ে যে ফজলুর রহমানের নাম নেই, সেটাও বিস্ময়ের। অসম্ভব দুঃখজনক।

কিশোর-যুবকেরা যদি নায়ক চিনতে ভুল করে, তারা বহুদূর যেতে পারে না। স্বপ্নের নায়ক হতে হয় অনেক বড়। ফজলুর রহমান খান হলেন তেমন মানুষ, যিনি নায়ক। অনেক বড় নায়ক! এই খানের কাজ দেখার জন্য শিকাগো শহরে গিয়েছিলাম। যে কয়দিন ছিলাম, শুধু খানের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে বেরিয়েছি। সেসব নিয়ে প্রথম আলোয় একটি লেখাও লিখেছি। দুনিয়ায় কিছু মানুষ থাকে যারা জন্ম, জাতীয়তা ও ধর্ম সবকিছু ছাপিয়ে পৃথিবীর সন্তান হয়ে যান। ফজলুর রহমান খান ছিলেন তেমন একজন। বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে বিশ শতকে তাঁর মতো এত পৃথিবী খ্যাতি পেয়েছেন, তেমন মানুষ খুব বেশি নেই আমাদের! ফজলুর রহমান ছিলেন আধুনিক শিকাগো শহরের রূপকার। স্কাইস্ক্র্যাপারের (গগনচুম্বী ভবনের) জনক। দুনিয়া কাঁপানো এক স্থপতি। তাঁর মতো মানুষের কথা পাঠ্যবইয়ে নেই! আফসোস!

সারা দুনিয়ায় আমাদের অনেক মানুষ আছেন, যারা জ্ঞান-গবেষণা ও বিজ্ঞানে অবদান রাখছেন। তবে কিছু কিছু মানুষের অবদান অনেক বড়। আমাদের সময়ের তেমন এক নায়কের নাম জাহিদ হাসান। জাহিদ হাসানের মতো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বড় বিজ্ঞানী খুব বেশি নেই। তিনি প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হওয়া কত কঠিন, সেটা আমাদের তরুণদের তেমন একটা ধারণা নেই। তার চেয়েও অনেক কঠিন হলো, সেখানে প্রফেসরশিপ ধরে রাখা। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্য ধরে না রাখতে পারলে, বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে কিক-আউট করতে দ্বিধা বোধ করে না। আমাদের দেশের মতো লাইফ গ‍্যারান্টেড ইউনিভার্সিটির চাকরি ইউরোপ-আমেরিকাতে নেই।

অন্য খবর  স্মার্টফোন বাজারের ভবিষ্যৎনামা

বিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কার (Breakthrough Discovery) বলে কিছু বিষয় থাকে। সেসব আবিষ্কার বহু বছরের অসমাধানকৃত প্রশ্নের (unsolved question) উত্তর দেয়। জাহিদ হাসান, পার্টিকেল ফিজিকস ও কোয়ান্টাম ফিজিকসে তেমন অবদান রাখছেন। তাঁর কাজ প্রকাশিত হয় বিজ্ঞানের দুনিয়াখ‍্যাত জার্নালে। তাই তাঁকে সংবাদপত্রের অফিসে গিয়ে বিজ্ঞান আবিষ্কারের ঘোষণা দিতে হয় না। প্রিন্সটন ছাড়াও আমেরিকার বিখ্যাত লরেন্স বার্কলে ন‍্যাশনাল ল‍্যাবরেটরির (LBNL) সঙ্গে তিনি যুক্ত। শুধুমাত্র তাঁর মেধা ও কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন আমেরিকার অনেক সম্মানজনক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশের ছেলে রুবাব খানের কথা তরুণদের জানতে হবে। নাসায় কাজ করা এই যুবক খুব অল্প বয়সে অনেক সফলতা অর্জন করেছেন। তরুণেরা কী জানে, রুবাব খান তার পিএইচডি থিসিস উৎসর্গ করেছেন কাকে? বাংলাদেশকে! সারা দুনিয়ায় নব্বই ভাগ পিএইচডি থিসিস যখন সবাই পরিবারের সদস‍্যদের উৎসর্গ করে, রুবাব তখন সেটা করেছে নিজের জন্মস্থানকে! অথচ, রুবাব খানকেই তরুণেরা চেনে না!

প্রয়াত আবদুস সাত্তার খান ছিলেন আমাদের দেশের আরেক মেধাবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রির ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। বাংলাদেশের অতি সামান্য কিছু বাঘা বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন এই আবদুস সাত্তার। নাসায় কাজ করেছেন। তার উদ্ভাবিত সংকর ধাতু (Alloy) ব‍্যবহার করা হয়েছে নাসার স্পেস শাটলে। তারাই হলেন নায়ক! সত‍্যিকারের নায়ক! এই সব অন্তরালের নায়কদের চিনতে হবে। তাদের কর্ম সম্পর্কে জেনে তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে থাকতে হবে।

বিজ্ঞানী রুবাব খান
বিজ্ঞানী রুবাব খান
আমাদের সময়ের এমন আরও কিছু নায়কদের একজন প্রফেসর সাইফ ইসলাম। ইউনিভার্সিটি অব ক‍্যালিফোর্নিয়া-ডেভিসের অধ্যাপক। আমেরিকার ন‍্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের (NAS) ফেলো। বিজ্ঞানের জন্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় সংগঠন এটি। এমন প্রতিষ্ঠান শুধু তাদেরই ফেলো নির্বাচিত করে, যারা বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। জাহিদ হাসান, সাইফ ইসলাম এদের মতো এমন বহু নায়ক আছেন, যাদের সোশ্যাল মিডিয়াতে পরিচয় নেই। তাঁরা ভার্চুয়াল জগতের নায়ক নন-তাঁরা সত‍্যিকারের নায়ক। তাঁদের কর্ম পৃথিবী বাঁচায়। তাঁদের কর্ম মানুষকে বাঁচায়। সভ্যতা একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যায় তাঁদের কর্ম।

অন্য খবর  এশিয়ার শীর্ষ ৩০ কোম্পানির মধ্যে বাংলাদেশ

আমাদের তরুণেরা যেন ভুলে না যায়, অলীক জগতের বাইরে একটা সত‍্যিকারের জগৎ আছে। পৃথিবী আছে। সেখানের নায়কদের চিনতে হবে। জানতে হবে। তাদের মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। এই সব নায়কদের চিনতে না পারলে, জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার তিয়াস জাগবে না। এই সব নায়কদের চিনতে না পারলে, জগতের এই বিশালতার সৌন্দর্য অনুধাবন করা যাবে না। এই সব নায়কদের চিনতে না পারলে, নিজের ক্ষুদ্রতাকে কখনোই পরিমাপ করা যাবে না। মানুষ যদি নিজের ক্ষুদ্রতাই পরিমাপ করতে না পারে, সে কখনো বড় হতে পারে না। পরিপূর্ণতার আত্মতৃপ্তি তাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম করে তুলে।

বড় হতে হলে বড় নায়ক চিনতে হয়। বড় মানুষদের জানতে হয়। তাদের কর্ম জানতে হয়। বড় হতে হলে বড় মানুষদের কথা অকৃপণভাবে তুলে ধরতে হয়। বড় হতে হলে, তরুণদের সঠিক নায়ক চিনতে হবে। জাহিদ হাসান, সাইফ সালাউদ্দিন, সাইফ ইসলাম, ফজলুর রহমান খান—এদের মতো নায়ক। যারা জন্মান ছোট্ট এক ঘরে, হয়ে যান সারা দুনিয়ার!

ড. রউফুল আলম: গবেষক। ইমেইল: <rauful.alam15@gmail.com>; ফেসবুক: <facebook.com/rauful15>

আপনার মতামত দিন