একসময় ইউরোপের “রুগ্ন মানুষ” নামে খ্যাত তুরস্ক প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বে পুনরায় ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে। অর্থনৈতিক, সামরিক ও ধর্মীয় ঐক্যের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেছে সুদূর আফ্রিকা থেকে শুরু করে এশিয়ার দেশগুলোর উপর। যদিও এখনো তুরস্কের বড় প্রভাব ইউরোপে থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ায় তা দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করছে।
২০১৯ সালের আগস্টে এশিয়াকে কেন্দ্র করে তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু প্রণীত “এশিয়া এ নিউ” পরিকল্পনা হাতে নেয়। এ পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে তুরস্কের যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের সিংহদ্বার হিসেবে বেছে নিয়েছে পাকিস্তানকে। এছাড়া বৈশ্বিক পরিস্থিতিকেও চমৎকারভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে এ সাফল্য ঘরে তুলতে চায় দেশটি। এক্ষেত্রে তুরস্কের নিয়ামক শক্তি হল তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি, চীনের সাথে বন্ধুত্ব, ভারতের সাথে চরম বৈরী নীতি, ভারতের দাদাগিরি করা দেশসমুহে ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা।
কাশ্মির ইস্যুতে যখন মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এবং ওআইসি ভূমিকা রাখতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে তুর্কী প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। ফলে তুরস্ক-ইসলামাবাদ সম্পর্ক কুটনৈতিক বিশ্বে চরম উষ্ণ পর্যায়ে পৌছেছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তুর্কী প্রেসিডেন্টের পাকিস্তান সফর ও পার্লামেন্টে বক্তব্য প্রদান সে উষ্ণ সম্পর্কের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশকে কাছে পেতে তুরস্ক রোহিঙ্গা ইস্যুতে কঠোর ভূমিকা শুধুমাত্র বিশ্বের ফোরামগুলোতেই নয় জাতিসংঘেও উপস্থাপন করেছে এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে কঠোর ভূমিকা রাখতে আহবান জানিয়েছে।
যেখানে বাংলাদেশের পরম বন্ধু হিসেবে খ্যাত ভারত সরাসরি মায়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে সেখানে তুরস্ক সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে অসহায় মানবিক বাংলাদেশের পাশে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির পুনর্বাসনে অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষে প্রভূত ভূমিকা রেখেছে।
ওদিকে যখন শ্রীলংকাকে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও রাশিয়ার মত দেশগুলো বাহুডোরে আবদ্ধ করতে চায় সেখানেও পিছিয়ে নেই তুরস্ক। কেননা ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের একমাত্র নিয়ামক উপাদান শ্রীলংকা। বিগত সুনামির সময় তুরস্ক শ্রীংলকা পুনর্গঠনে ব্যাপক অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ উন্নত একটা গ্রাম তৈরী করে দিয়েছিল।
আবার মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর উপর দেশটির রয়েছে বিশেষ নজর। ২০২১ সালের ৬ থেকে ৯ মার্চের মধ্যে মধ্য এশিয়ার তিনদেশ (তুর্কমেনিস্থান, উজবেকিস্থান, কিরগিজস্থান) সফর করেছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু। সেখানে তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু বিনিয়োগই নয়, মুক্ত বাণিজ্যের উপর জোর দিয়েছেন।উজবেকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তুরস্ক তাদের বিনিয়োগ ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চুক্তিও সম্পাদন করেছে।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসে কিরগিজস্তানের মনাস ইউনিভার্সিটিতে আনতালিয়া ডিপ্লোমেসি ফোরামে প্রদত্ত ভাষণে তুর্কী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আগামির শতক এশিয়ার শতক। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অর্ধেক এশিয়ার। এ কারনেই তুরস্ক চাইছে এশিয়ার সাথে যুক্ত হতে।”
১৯২৩ সালে কামাল পাশা ক্ষমতা গ্রহন করার পর তার নেতৃত্বে তুরস্ককে গোটা মুসলিম দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার নীতি অবলম্বন করা হয়। সে নীতি ধর্মনিরপেক্ষতার “কৃত্রিম দেয়াল” রচনা করে দেশটিকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল দীর্ঘ সময়। বর্তমানে সে দেয়াল ভেঙে তুরস্ক একে অপরকে আলিঙ্গন করছে। ফলে মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে দেশটি।
মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের প্রবন্ধে সাবেক গোয়েন্দা প্রধান পল গোবল বলেছেন, “তুরস্কের সহযোগিতায় আজারবাইজান যেভাবে আর্মেনিয়াকে পরাস্ত করেছে তা এ অঞ্চলে তুরস্কের আধিপত্য বিস্তারের দ্বার খুলে দেবে। “লাপিস লাজুলি” করিডোরের মাধ্যমে দেশটি আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়াবে এবং প্রভাব বিস্তার করবে।
তুরস্কের সেন্টার ফর ডিপ্লোমেটিক অ্যাফেয়ার্স এ্যান্ড পলিটিক্যাল স্টাডিজের উপদেষ্টা মেসুদ হাক্কি কাসিন তুরস্ক, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্তরের ভিন্নতা দূরীকরণে সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ করার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, তুরস্ক, পাকিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো অর্থনীতির ভিন্ন ভিন্ন স্তরে রয়েছে, এদের মধ্যে কৌশলের সমন্বয় জরুরী।”
তিনি আরো বলেন, “এটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। যখন চীন, পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর “ সিপেক” আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া হয়ে অন্যান্য দেশের সাথে যুক্ত হবে।” তিনি এ অঞলের দেশসমুহের নিরাপত্তার ব্যাপারে আঞ্চলিক দেশসমুহের সমন্বয়ের উপর জোর দিয়েছেন। উসমানি খেলাফতের আকাঙক্ষা ও প্যান ইজলামিজম ধারণার বিকাশের মাধ্যমে খুব সহজেই তুরস্ক এসব দেশে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। সেক্ষেত্রে এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠির সমর্থন দেশটির পক্ষেই থাকবে তা হলফ করেই বলা যায়। তবে চীন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপারে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে কৌশল ও সমন্বয় সাধন নীতিমালা তৈরী করা একান্ত জরুরী।
রাশিয়ার অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল উদ্বেগের সাথে বলেছেন, “তুরস্ক স্পষ্টতই তুরান প্রকল্পের (আজারবাইজানের উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া ইউরোপমুখী বিকল্প গ্যাস পাইপলাইন) দিকে অগ্রসর হচ্ছে আর আমরা পাশে দাড়িয়ে অলসের মত দেখছি। সময়ের সাথে সাথে রাশিয়া এ প্রকল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে।” তিনি আরো বলেন, “ক্রিমিয়া, আজারবাইজান এবং তুর্কী প্রজাতন্ত্রগুলোতে রাশিয়া অসহায়ের ন্যায় তুরস্কের নীতির উপর নির্ভর করছে।”
সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় নজর দেওয়ার ক্ষেত্রে সফট পাওয়ার অ্যাসেটকে (সংস্কৃতি, মতাদর্শ, পররাষ্ট্রনীতি) কাজে লাগাতে চায়। এছাড়াও বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখা, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় দেশটি। এখানে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশকে মূল চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।
এছাড়াও এশিয়ার রাজনীতিতে চীন-ভারতের বৈরী নীতিকে কাজে লাগাতে চায় মেভলুত কাভুসোগলু ও তার সহযোগিরা। যদিও ভারতের সাথে বর্তমানে তুরস্কের সম্পর্ক বেশ বৈরী।
তুর্কী রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিনেম চিঙ্গিস আরব নিউজের এক প্রবন্ধে লিখেছেন,“ মেভলুত কাভুসোগলুর পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে দেশগুলোর অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার গতি ও ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের কারণে।” তবে গত আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রন নেওয়ার পর এ পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনেছে তুরস্ক। এ পরিকল্পনায় আফগানিস্তান যুক্ত হওয়ায় চীনকে কাছে টেনে ভারতেকে দূরে ঠেলে দেয়ার নীতি গ্রহন করেছে তা তুরস্কের সাম্প্রতিক আচরনে অনুমান করা যায়।
এছাড়া দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাধিক্য তুরস্কের গ্রহনযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। শুধু তাই নয়, প্রায় ৩০ কোটি ভারতীয় মুসলমানকে অণুপ্রাণিত করেছে।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের (আইএসএএস)প্রকাশিত এক পলিসি পেপারে ভারতীয় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বিনয় কাউরা লিখেছেন,“সৌদি আরবের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের স্থান পাওয়ার তাগিদে আঙ্কারা এখন ভারতীয় মুসলমানদের কাছেও পৌছেছে।” তবে সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী দলগুলো যদি জোটবদ্ধভাবে সাম্পদায়িক বিজেপিকে পরাস্ত করতে পারে তবেই ভারতের মুক্তি মিলবে নতুবা আগামিতে কাশ্মিরসহ স্বাধীনতাকামী প্রদেশগুলোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এমনকি হাতছাড়াও হতে পারে।
কেননা তুরস্ক, চীন ও পাকিস্তান পরিকল্পনার কাছে দূরবর্তী জাপান, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত কোয়াড শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ ভারত ইতিমধ্যে তার সবগুলো বন্ধুরাষ্ট্র মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভূটানকে হারিয়েছে। সর্বশেষ অকৃত্রিম বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছে এদেশের মানুষ ও সরকার। এমন পরিস্থিতিতে তুরস্ক যে সহযোগিতার উদাহরণ বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পক্ষে দেখিয়েছে তাতে এ ভূখন্ডের জনগণ ও সরকারের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে দেশটি। সার্বিক পর্যালোচনা বলছে আগামীর এশিয়া হবে শুধুমাত্র তুরস্কের জন্য।
লেখক: আব্দুল খালেক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক
![]() |
ReplyForward
|
আপনার মতামত দিন
