ইসলামে নান্দনিকতা ও শিল্পকলার প্রতি উৎসাহ

866
ইসলামে নান্দনিকতা ও শিল্পকলার প্রতি উৎসাহ

বিজ্ঞানের বিকাশে কোরআনে কারিমের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে শিল্পকলার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও। কোরআন মুসলমানদের শিল্পকলার চর্চায় উ‍ৎসাহিত করেছে। যেমন- সুন্দর ও সহিহশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত থেকেই সুললিত উচ্চারণের একটি শাখার উদ্ভব হয়েছে। আবার কোরআন সংরক্ষণ প্রচেষ্টা থেকেই ক্যালিওগ্রাফি বা সুন্দর হস্তলিখন এবং বাঁধাই শিল্পের সূত্রপাত ঘটেছে। মসজিদ নির্মাণশৈলী থেকেই সৃষ্টি হয়েছে স্থাপত্য এবং অলঙ্করণ শিল্পের।
মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন।’ অন্য হাদিসে ‘সবকিছুর মধ্যে সৌন্দর্য বজায় রাখতে’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একদিন নবী করিম (সা.) একটি কবরস্থান দেখতে পেলেন; কিন্তু কবরস্থানটি পুরোপুরি সমান ছিলো না। তখনই কবরস্থানটি সংস্কার করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন, কবরস্থানটি সংস্কার করার সঙ্গে মৃত ব্যক্তির মঙ্গল-অমঙ্গলের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমাদের চোখে এটা দেখতে ভালো লাগে। আল্লাহ এটা পছন্দ করেন যে, আমরা যখন কোনো কাজ করব, তখন তা অবশ্যই যথাসম্ভব সুন্দরভাবে করবো। -ইবনে সাদ
ললিতকলার প্রতি মানুষের একটি স্বভাবজাত আকর্ষণ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা অফুরন্ত প্রাকৃতিক নিয়ামতের মতো শিল্পকলা সম্পর্কিত প্রতিভাও একটা নিয়ামত। শিল্পকলা মানুষের জীবনাচরণের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
এখানে বলে রাখা আবশ্যক, ইসলামে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ির অবকাশ নেই। এমনকি সংযমের নামে মাত্রাতিরিক্ত কৃচ্ছ্রসাধন এবং বৈরাগ্য ইসলামে নেই।
নবী করিম (সা.)-এর জন্য সর্বপ্রথম যে মিম্বরটি তৈরি করা হয়েছিল, তাও দু’টি গোলক বা গোলাকার বস্তু দ্বারা সাজানো হয়েছিল। গোলক দু’টি ছিল অনেকটা ডালিমের মতো। নবী করিম (সা.)-এর দুই প্রিয় নাতি এ গোলক দু’টি দিয়ে বেশ মজা করে খেলতেন। এখান থেকেই কাঠের কারুকাজের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে কোরআনের কপিগুলো নানা রঙে সুশোভিত করা হয় এবং সেগুলো বাঁধাইয়ে দারুণ যত্ন নেওয়া হয়।
সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, শিল্পকলার বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না। বাধা-নিষেধ আরোপ করে থাকে শুধু প্রাণীর প্রতিকৃতি চিত্রায়ন বা নির্মাণের ক্ষেত্রে। এর পেছনেও কতগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। কারণগুলো প্রধানত মনোজগত, সামাজিক, জীববিদ্যা ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে সম্পর্কিত।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মূর্তিমান শিল্পের ব্যাপারে ইসলামে যে বিধি-নিষেধ রয়েছে তা কখনও মুসলমানদের শিল্পচর্চাকে ব্যাহত করতে পারেনি; বরং তাদের হাতে বিমূর্ত শিল্পচর্চার যে বিকাশ ঘটেছে তা খুবই বিস্ময়কর। কোরআনে মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে সাজসজ্জার অনুমোদন রয়েছে। -সূরা নূর: ৩৬
মুসলমানরা ছবি আঁকার পরিবর্তে ক্যালিওগ্রাফিকে গ্রহণ করেছে শিল্পকর্ম হিসেবে। বলতে গেলে এটি তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ। তারা প্রধানত অঙ্কন, কাপড় ও বিভিন্ন দ্রব্য চিত্রায়নের কাজে ক্যালিওগ্রাফি ব্যবহার করে থাকে। যেসব ক্যালিওগ্রাফি দরদ, যত্ন ও নৈপুণ্যের সঙ্গে প্রণীত হয়েছে, সেগুলোর মান খুবই উন্নত। দেখতেও চমৎকার এবং মনোমুগ্ধকর। এগুলোর সৌন্দর্য সত্যিই অবর্ণনীয়।
কোরআন তেলাওয়াত মুসলমানদের শিল্পচর্চার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। কোরআন তেলাওয়াতে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের অবকাশ নেই। কোরআনের সব আয়াত সমান ও একই মাত্রার নয়। নবী করিম (সা.)-এর কাল থেকে মুসলমানরা পরম আগ্রহের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত করে আসছেন। কোরআনের নিজস্ব একটি গতি ও ছন্দ আছে। এর আয়াতগুলো খুবই শ্রুতিমধুর ও মিষ্টি। অন্য যে কোনো ভাষার গতি ও ছন্দের মান যত উন্নত ও চিত্তাকর্ষকই হোক না কেন, তা কখনও কোরআনের মিষ্টি মধুর সুরকে ম্লান করতে পারে না।
কবিতা সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, এমন কিছু কবিতা আছে যেগুলো জ্ঞানের গভীরতায় পরিপূর্ণ। আবার কোনো কোনো বক্তার বক্তব্যের কার্যকারিতা একেবারেই চিত্তাকর্ষক। কোরআনে নৈতিকতাবিরোধী কবিতাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কোরআনের এই বিধানের প্রতি লক্ষ্য রেখেই নবী করিম (সা.) তদানীন্তন কবিদের সঠিক পথনির্দেশ দিয়েছেন। তাদের জানিয়ে দিয়েছেন তাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে।
সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলা যায়, শিল্পকলার বিকাশের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারা নতুন নতুন এমন অনেক বিষয় উদ্ভাবন করেন যা ছিল মানুষের চিন্তার বাইরে। অথচ এক্ষেত্রে তারা চম‍ৎকার রুচির পরিচয় দেন এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলোকে সযত্নে পরিহার করেন।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সেটা হলো- অতি অল্প সময়ের মধ্যে মুসলমানরা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ অবস্থায় মুসলমানদের যদি নিজস্ব কোনো শিল্প-সংস্কৃতি না থাকত, নবী করিম (সা.) যদি মুসলমানদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতিবোধকে উজ্জীবিত না করতেন, তাহলে সহজেই তারা অমুসলমানদের সংস্কৃতির মধ্যে বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু বাস্তবে এমনটা হয়নি। বরং বিজিত এলাকার লোকের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই মুসলমানদের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলত। আর এটা তারা করত মানবতার বৃহত্তর স্বার্থেই।

আপনার মতামত দিন