ব্ল্যাক হোল

বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, গাজীপুর এর একজন এক্স সিনিয়র সাইন্টিস্ট আমার সাথে বিগ ব্যাং তত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছে। আমি তাকে বলেছি এই দুঃসাহস যেনো আমার না হয় এতে তিনি কি মনে করেছেন জানি না। যেকোন কারনে আমি তার নাম এখানে বলছি না তবে আজকের এই লেখাটা তাকে স্বরন করে। বিগ ব্যাং তত্ব নিয়ে কথা উঠাতেই আমি এটা নিয়ে লেখার কথা চিন্তা করি। বিগ ব্যাং নিয়ে যতটুকুই জানি সেটা নিয়ে পরে আরেকদিন লেখার চেষ্টা করবো আজ ব্ল্যাক হোল নিয়েই আলোচনা করবো। এখানে আমি চেষ্টা করেছি সকলের সহজ বোঝার সুবিদার্থে একদম সহজ ভাষা ব্যবহার করার।

আমাদের পৃথিবীটা যেই সৌরজগত এর মধ্যে অবস্থিত সেই সৌরজগত এর বাইরে যে মহাবিশ্ব আছে সেখানে খুবই রহস্যময় হাজার হাজার বিষয় ও বস্তু আছে। আমরা কিন্তু সবাই সেই বিষয়গুলি নিয়ে খুব একটা জানতে চাই না। তবে যারা বিজ্ঞানের উপরে বিশ্বাস রাখে তাদের ৫০% কে দেখা যায় এসব অজানা নিয়ে আরো জানতে আগ্রহী কিন্তু, বাকী ৫০% জীবনে কয়েকবার মাত্র আকাশের দিকে যখন সময় পায় তখন একটু তাকিয়ে মনে মনে কল্পনা করে কি আছে এই আকাশে। কিছু তারা ও চাঁদ দেখতে পারলেই মহাকাশ সম্পর্কে জানার ইচ্ছা শেষ হয়ে যায় তাদের। এরা তো তাও একটু আছে বলতে হবে, কিন্তু তাদের কথা একটু ভেবে দেখুন যারা সৌরজগতের এই সব প্রাকৃতিক ঘটনার সাথে তাদের ধর্মীয় কিতাব এর মিল খুজে তারা আবার কি জিনিষ। তাদের ধারনা সৌরজগত এর এসব ঘটনা কেউ একজন সৃষ্টি করেছেন এবং আজকের সৌরবিজ্ঞানীরা এই সৌরজগত নিয়ে যা আবিষ্কার করছে তা আজ থেকে হাজার বছর আগেই কোন ধর্মীয় কিতাবে লেখা ছিলো। সেই আলোচনায় আজকে যাবো না আজ ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে অল্প কিছু আলোচনা করবো।

এই রহস্যময় মহাবিশ্বের অনেক রহস্যময় জিনিসের মধ্যে মানুষ আজ পর্যন্ত খুব অল্প কিছুই জানতে পেরেছে। কিন্তু সেটা কতটুকু তা বলার চেয়ে এটা বলা আমি শ্রেয় মনে করি যে আজ পর্যন্ত মানুষ এই মহাবিশ্বের কতটুকু জানতে পারেনি। সেটা হচ্ছে ৯৯,৯৯% এখনও মানুষের অজানা। তাহলে একবার ভেবে দেখুন এই মহাবিশ্বের কি জানতে পেরেছে আজকের পৃথিবীর মানুষ। তবে বিশ্বাসীদের মতে পৃথিবী থেকে দুইভাগ করে ফেলা সেই চাদে মানুষ আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর আগেই ঘুরে এসেছেন। চাদের থেকেও এই মহাবিশ্বের আরো একটি রহস্য হচ্ছে এই ব্ল্যাক হোল। মহা বিশ্বের সবচেয়ে বড় রহস্য, সবচেয়ে বড় মহাজাগতিক বিস্ময়, ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর। ব্ল্যাক হোল হলো আমাদের সূর্যের মত এক ধরনের নক্ষত্র। কোন নক্ষত্রের যদি অনেক ভর ও ঘনত্ত্ব থাকে, তাহলে তার মহাকর্ষীয় শক্তি এতই শক্তিশলী হবে যে আলো পর্যন্ত সেখান থেকে নির্গত হতে পারবে না। মহাকর্ষীয় শক্তি আবার কি তাই না ? এ মহাবিশ্বের যেকোন দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষন তাই হচ্ছে মহাকর্ষীয় শক্তি। এই নক্ষত্রের থেকে আলো কিছু দূর যাওয়ার আগেই নক্ষত্রটির মহাকর্ষীয় আকর্ষন দারা তাকে পিছনে নিয়ে আসে। পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই কৃষ্ণ গহ্বর সম্পর্কে এ পর্যন্ত জানতে পেরেছেন সামান্যই। তবে যতটা তথ্য উদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন তা যথার্থই অভাবনীয়, সাধারণ চিন্তার বাইরে।

অন্য খবর  মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল যেভাবে

এই ব্ল্যাক হোল গুলা কিন্তু আমাদের পৃথিবী তেকে সরাসরি দেখা সম্ভব হয় না। ধারনা করা হয় মহাবিশ্বের এই ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয়েছে নক্ষত্র যখন তার জ্বালানি পুড়িয়ে শেষ করে ফেলে তখন নক্ষত্র গুলো সংকুচিত হতে থাকে। সাধারনত গ্যালাক্সি গুলোর মাঝে অবস্থানরত বড় বড় নক্ষত্র তাদের বিবর্তনের সর্বশেষ পরিণতিতে সুপারনোভা বিস্ফোরনের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি করে। নক্ষত্র গুলো অনেক বেশি সংকুচিত হয়েই ব্ল্যাক হোলের জন্ম দেয়। কিন্তু সেই সংকুচিত হওয়ার মাত্রা কতটুকু তা শুনে হয়তো একটু অবাক হবেন। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যের ব্যাসর্ধ প্রায় ৬.৯৬০০০০০ কিলোমিটার। এই বিশালাকার আয়তনকে যদি কোনোভাবে মাত্র ১০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা যায়, তাহলে সেটি এই মহাবিশ্বের একটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে। আর আমাদের পৃথিবীকেই যদি চেপেচুপে মাত্র দশমিক ৮৭ সেন্টিমিটা বানানো যায়, তাহলে পৃথিবীও একটি ক্ষুদে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতে পারে। ব্ল্যাক হোল হওয়া তাহলে সোজা ব্যপার না তাই না এটা কিন্তু পরিষ্কার।

এই ব্ল্যাক হোল এর আরো একটি আশ্চর্য করার মতো বিষয় আছে। ব্ল্যাক হোল থেকে আলো কিছু দূর যাওয়ার আগেই ব্ল্যাক হোলটির মহাকর্ষীয় আকর্ষন দ্বারা তাকে পিছনে নিয়ে আসে। ঠিক বুঝলেন না ব্যাপারটা। আরো ভালো করে বোঝার জন্য আপনাকে ইউটিউবের কিছু ভিডিও দেখতে বলবো। ধরুন এমন কি কখনও হতে পারে আপনি টর্চ লাইট দিয়ে সোজা আলো মারলেন কিন্তু সেটা মাঝামাঝি গিয়ে বাকা হয়ে অন্য যায়গায় গিয়ে পড়লো। এরকম ঘটতে পারে মহাবিশ্বের এই ব্লাক হোল নামক যায়গাটিতে। অবাক হবার কিছুই নাই এর চেয়ে অবাক করার মতো কথা হচ্ছে আপনি যদি স্বশরীরে এই ব্ল্যাক হোল এর ভেতরে পড়ে যান তাহলে আমরা আপনাকে পড়ে যেতে দেখবো কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনি নিচে পড়ছেন তো পড়ছেনই যার কোন শেষ হচ্ছে না আমরা যদি কয়েক বছর পরেও আবার আপনাকে দেখতে যায় যে নিচে পড়েছেন কিনা তখনও দেখবো আপনি পড়ছেন তো পড়ছেনই মনে হচ্ছে উপর থেকে নিচের কোন শেষ নাই। আবারও বলছি আমি আসলে সকলের বোঝার সুবিধার্থে এখানে খুবই সহজ ভাষা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি।

এরকম আরো কি আশ্চর্য হবার মতো ঘটনা আছে এই ব্ল্যাক হোল এর ভেতরে যা আমাদের এই পৃথিবীতে কখনই ঘটে না। আলোর ব্যাপারটি দেখুন। যেহেতু এই ব্লাক হোল থেকে আলো পর্যন্ত বের হয়ে আসতে পারে না তাহলে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ত কিভাবে দেখা যায় বা বুঝা যায় এরকম প্রশ্ন উঠতে পারে। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে, অনেক সময়েই মহাকাশে প্রচুর তারকারাশি দেখা যায় যারা একটি বিশেষ বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অথবা সর্পিলাকার গ্যাসীয় বস্তু দেখা যায় যা কোন বিন্দুকে কেন্দ্র করে অবস্থান করছে। এই বিশেষ বিন্দুগুলোই হল ব্ল্যাক হোল যেগুলোকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকই কিন্তু তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তারকারাশি বা গ্যাসীয় বস্তুগুলোর অবস্থান আর তাদের গতি-প্রকৃতির মাধ্যমে। বর্তমানে কিছু উন্নত প্রযুক্তি ব্যাবহার করে কিছু টেলিস্কোপ দিয়ে নেগেটিভের মতো কিছু ছবিও তুলে দেখাতে সক্ষম হয়েছে সৌরবিজ্ঞানীরা।

ব্ল্যাক হোল থেকে এক জাতীয় চম্বুকীয় তরঙ্গ বের হতে থাকে যা এই ব্ল্যাক হোল এর আশেপাশে থাকা সকল বস্তুকে ভেতরের দিকে টানে। এই ব্ল্যাক হোল অতিমাত্রায় কৃষ্ণকায় বা কালো হওয়ার দরুণ ব্ল্যাক হোল আমাদের কাছে এই পৃথিবী থেকে অদৃশ্য বটে কিন্তু এর থেকে নিঃসরিত বিকিরণ জনিত শক্তি প্রতিনিয়তই নির্ণেয়মান। যা থেকে সৌরবিজ্ঞানীরা আমাদের সঠিকভাবেই বলতে পারেন এই ব্লাক হোল এর অবস্থান ও তার গতিবিধি। এই ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে এখনো বিজ্ঞানিরা ৯৯,৯৯% জানতে পারে নি। তাই এটি এখনো রহস্যময় একটি জগত হয়ে আছে আমাদের কাছে। তারপরেও আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তা থেকে খুব ভালোভাবেই বোঝা যায় ব্ল্যাক হল এর আচরন কেমন। আবার আরেকটি উদাহরন দেখুন, ধরা যাক, আপনার পা ব্ল্যাক হোলের দিকে আছে। ফলে আপনার শরীরে কি ঘটছে তা দেখতে পাবেন। আপনার পা ব্ল্যাক হোল এর দিকে থাকার কারণে আপনার শরীরের নিচের অংশ বেশী আকর্ষণ অনুভব করবে। আকর্ষণের টানে আপনার শরীর চুইং গামের মত হয়ে যাবে। তারপর একসময় আপনার শরীর নুডুলসের মত হয়ে যাবে। এরপর আপনি ব্ল্যাক হলের ভেতরে গিয়ে পড়বেন আর এসবই হবে সেই চম্বুকীয় তরঙ্গের কারনে।

অন্য খবর  সকল সরকারি সেবা ৩৩৩ উদ্বোধন

সূর্যের চেয়ে কমপক্ষে দশগুণ বড় নক্ষত্রদের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে এরা সঙ্কুচিত হতে হতে অতি খুদ্র অন্ধকার বিন্দুতে পরিণত হয়। এধরণের ব্ল্যাক হোল কে বলা হয় স্টেলার মেস (Stellar Mass) ব্ল্যাক হোল। বেশীরভাগ ব্ল্যাক হোলই এধরণের। কিন্তু নক্ষত্রের সঙ্কুচিত হয়ে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হওয়ার পরও ব্ল্যাক হোলে নক্ষত্রের সমান ভর ও অভিকর্ষ টান থাকে। আমাদের গ্যালাক্সিতে সম্ভবত ১০০ মিলিয়ন ব্ল্যাক হোল রয়েছে যার কয়েকটির মাত্র সন্ধান আমরা পেয়েছি আজ পর্যন্ত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে প্রতি সেকেন্ডে একটি ব্ল্যাক হোল সৃষ্টি হয়। আরেক ধরণের ব্ল্যাক হোল হল সুপার মেসিভ (Super massive) ব্ল্যাক হোল। তাদের এক মিলিয়ন তারার ভর এমনকি এক বিলিয়ন তারার ভরও থাকতে পারে। সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোলরা কোন গ্যালাক্সির মিলিয়ন বা বিলিয়ন তারাকে একত্রে ধরে রাখে। আমাদের গ্যালাক্সিতেও কিন্তু একটি সুপার মেসিভ ব্ল্যাক হোল আছে। সেটির নাম Sagittarius A (উচ্চারণ আমার জানা নাই), যা আবিষ্কৃত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে। তাহলে একবার একটু ছোট্ট একটি চিন্তা করুন আমরা জানি যে আমাদের এই বিশাল পৃথিবী থেকে যেই ছোট্ট সূর্যটি আমরা দেখতে পায় তা আমাদের এই পৃথিবী থেকে ১৩ লক্ষ গুন বড় একটি বস্তু। তার মানে এই সূর্যের কাছে আমাদের পৃথিবী কিছুই না। আবার যেই নক্ষত্র বা তারার কথা বলা হচ্ছে যাদের এই ব্ল্যাক হোল গিলে ফেলতে পারে সেই নক্ষত্র গুলার একেকটার আকৃতি কিন্তু এই সুর্য থেকে কয়েক হাজার এমনকি কয়েক লক্ষ গুন বড় হতে পারে। তাহলে একটি ব্ল্যাক হোল বা (Super massive) ব্ল্যাক হোল এর ভেতরে আমাদের এই পৃথিবীর সমান কতটা পৃথিবী ধরতে পারে একটু চিন্তা করে দেখুন একবার। দরকার নেই থাক। আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এতোই বিশাল যে এর গ্রহ-উপগ্রহ, তারা, নক্ষত্র বিজ্ঞানীদের প্রায়ই ধাঁধায় ফেলে দেয়। আর এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ‘ইউওয়াই স্কুটি’ (UY Scuti) নামের সবচাইতে বড় তারা যেটা একাই বিজ্ঞানীদের মাথা গুলিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

আপনার মতামত দিন