৪২ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বোঝেন না

69

প্রায় একযুগ আগে সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হলেও অদ্যাবধি তা আয়ত্ত করতে পেরেছেন মাত্র ৫৮ শতাংশ শিক্ষক।

তবে বাস্তবে এ চিত্র আরও করুণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বরিশাল অঞ্চলের এক শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, সৃজনশীল বোঝে এবং প্রশ্ন করতে পারে এমন শিক্ষকের সংখ্যা ২০ শতাংশের মতো।

সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকরা পরীক্ষার প্রশ্ন নিজেরা প্রণয়ন করেন না। কোথাও শিক্ষক সমিতি আবার কোথাও বিভিন্ন পেশাদার প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রশ্ন কিনে আনে স্কুলগুলো। আবার অনেকে গাইড বই দেখে প্রশ্ন তৈরি করেন। অথচ গাইড ও নোটবইয়ের দাপট কমাতে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে।

মাউশি পরিচালক অধ্যাপক আবদুল মান্নান সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নের এ করুণ হালের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনি শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন তৈরি করতে যে পরিমাণ দক্ষতা দরকার তা অনেক শিক্ষকেরই নেই।

হয়তো টেনেটুনে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার প্রশ্ন শিক্ষকরা করেন। কিন্তু ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন অনেকেই গাইড বই দেখে তৈরি করেন। অনেকে আবার নানাভাবে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন।

এটা থেকে বাস্তবে কোনো উত্তরণ ঘটেনি। সৃজনশীল বোঝেন এ সংখ্যাটা কম, যা আছে তা আশানুরূপ নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেসিপ প্রকল্পের মাধ্যমে একমুখী শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চাপিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এরই অংশ হিসেবে ২০০৪ সালে প্রথম এ পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত করতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তখন এর নাম ছিল কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতি।

অন্য খবর  বিনয় জান্নাতি মানুষের স্বভাব

একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নেতৃত্বে গড়ে উঠা আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালে সরকার আর একমুখী শিক্ষা চালু করতে পারেনি।

পরে অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের উদ্যোগে দেশের শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্ত হয়।

এ উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষকও যোগ দেন। সেখানেই কাঠামোবদ্ধ পদ্ধতির পরিবর্তে এর নামকরণের সিদ্ধান্ত হয় সৃজনশীল পদ্ধতি।

এরপর ২০০৭ সালের জুনে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের সরকারি আদেশ জারি হয়। ২০০৮ সাল থেকে পদ্ধতিটি নবম শ্রেণীতে চালু হয়। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম প্রবর্তন ঘটে। সেই হিসাবে জুনে এ পদ্ধতি প্রবর্তনের একযুগ হচ্ছে।

কিন্তু এতদিনেও এ পদ্ধতি শিক্ষকরা পুরোপুরি আয়ত্বই করতে পারেননি। এ ব্যাপারে মাউশির ‘একাডেমিক তদারকি প্রতিবেদন’ শীর্ষক সমীক্ষা বলছে, ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের দক্ষতা অর্জন করেছেন।

তারা এ পদ্ধতিতে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। বাকি ৪১ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের প্রশ্ন তৈরি করতে পারেন না। এদের মধ্যে ১৩ দশমিক ১২ শতাংশের অবস্থা খুবই নাজুক। এ ধরনের শিক্ষকরা নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না।

তারা শিক্ষকদের বিভিন্ন সমিতি থেকে ‘রেডিমেড’ প্রশ্ন কিনে ছাত্রদের পরীক্ষা নেন। বাকি ২৮ দশমিক ৬১ শতাংশ শিক্ষক অন্য স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় আংশিক প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। মাউশির আওতাধীন নয়টি অঞ্চলের ৬ হাজার ৯৯৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিচালনা করা হয় ওই সমীক্ষা।

অন্য খবর  এসএসসিতে ৪ বিষয়ে পরীক্ষা হবে না, নম্বর বিভাজন যেভাবে

সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৫৮ দশমিক ২৭ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল বিষয়ের প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারেন। এর মধ্যে নিজস্ব শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্ন প্রণয়নের হার সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ অঞ্চলে, ৭৮ দশমিক ১৩ ভাগ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশকিছু কারণে সৃজনশীল পদ্ধতি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এর মধ্যে এক নম্বরে আছে শিক্ষকদের সদিচ্ছার অভাব। এছাড়া আছে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না পাওয়া, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্বল মনিটরিং, শিক্ষকদের কোচিং মানসিকতা এবং বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির ব্যবসা।

সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে সরকার বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট (বেডু) নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে। এ সংস্থার পরিচালক অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষকের মান। সাধারণ শিক্ষক দূরের কথা, মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণেও আমরা এমন অনেক শিক্ষক পাচ্ছি যারা ঠিকমতো সৃজনশীল বোঝেন না। এমনকি প্রশিক্ষণের ভাষাও বোঝেন না অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি কম হলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

বেডু পরিচালক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, এটা ঠিক যে, সৃজনশীলে প্রশ্ন প্রণয়ন অত সহজ নয়। এর জন্য শিক্ষকের ওই বিষয়ে গভীর জ্ঞান থাকা দরকার। বুঝতে হবে শিক্ষা মনঃস্তত্ত্ব। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রত্যেক স্কুলে প্রত্যেক বিষয়ে অন্তত একজন শিক্ষক সৃজনশীলে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। কথা ছিল, তারা গিয়ে বাকিদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এ প্রশিক্ষণ কতটা কার্যকর, সেটা নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন। তবে আমরা প্রশিক্ষণ আরও কার্যকরী করতে চাই। এজন্য আসন্ন জুনে ৬ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হবে।

আপনার মতামত দিন