ঠিক কতো টাকা চুরি করলে একজন নেতার পেট ভরে?

550

দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, মামলা, সাজা এমন অনেক কিছু শুনতে হচ্ছে গত কয়দিন যাবৎ। আমাদের দেশে যেমন সাজা ভোগ করতে হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে। ক্ষমতায় আরোহণ করে অর্থবিত্তের লোভ সামলানো কি এটি কঠিন? “যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ” এ প্রবাদের সার্থকতা প্রমাণে এই উপমহাদেশের শাসকেরা যেমন রাবণ হয়ে যান, ঠিক তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় এমন রাবণের অভাবে নেই।

ইতিহাসে আমরা যেমন অনেক সৎ-নিষ্ঠাবান শাসক দেখেছি, তেমনি অনেক শাসক দেখেছি ক্ষমতার মোহে জনগণ আর দেশের প্রতি নিজ দায়িত্ব ভুলে অঢেল সম্পদের মালিক হতে। আজকে আমরা এমনই কয়জন শাসকের কথা জানবো যারা ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত দুর্নীতিবাজ, যারা দেশ ও জনগণের তোয়াক্কা না করে দেশে-বিদেশে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের বিশাল রাজত্ব। শুরু করছি নাম্বার ৫ থেকে।

৫. বেন আলী
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণঃ ১ বিলিয়ন- ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

যারা সাম্প্রতিক বিশ্বের একটু-আধটু খোঁজ-খবর রাখেন, তাদের সবার কাছে এই নামটি অতি পরিচিত। তিনি তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত। এরপরেই এই তিউনিসিয়া থেকে শুরু হওয়া আরব বসন্তের হাওয়ায় সর্ব প্রথম নড়ে ওঠে তার ক্ষমতা আর সম্পদের মসনদ ।

দূর্নীতিবাজ নেতা:বেন আলী

তার শাসনামলে তিউনিসিয়ার উন্নয়ন হয়েছে অনেক। মাথাপিছু আয় ১৯৮৬ সালে যেখানে ছিলো ১২০১ মার্কিন ডলার, সেখানে ২০০৯ সালে তিনগুণেরও বেশি বেড়ে হয় ৩৭৮৬ মার্কিন ডলার। দারিদ্রের হার কমে ৭.৪ থেকে হয় ৩.৮। কিন্তু লাগামছাড়া দুর্নীতি আর সম্পদের লোভ সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। বেকারত্ব বাড়তে থাকে দেশটিতে। যার ফল হিসেবে আসে আরব বসন্ত।

ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বেন আলী ও তার পরিবার প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জন করে বলে নানা অভিযোগ আছে। যার মাঝে বহু অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে। বেন আলী, তার পরিবারের সদস্য সহ ১১৪ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। ক্ষমতা থেকে চলে যাবার সময় ছোট বড় ৪০০টি কোম্পানি, ৫৫০টি বাড়ি, ৩৬৭টি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মেলে। তিউনিসিয়া ছাড়ার সময় বেন আলীর স্ত্রী প্রায় দেড় টন স্বর্ণ সাথে করে নিয়ে যান। এই বিশাল সম্পদ ২০১১ সালের তিউনিসিয়ার জিডিপির চার ভাগের এক ভাগ বলে ধারণা করা হয়।

উদ্ধারকৃত সম্পদঃ
ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকেই নানা ভাবে রাষ্ট্রের এই সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা শুরু হয়। লেবাননের ব্যাংকে থাকা তার স্ত্রীর নামে ২৪.৪ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা হয়। সুইজারল্যান্ড থেকে আসে ৪০ মিলিয়ন। আর সুইজারল্যান্ডেই ২৮.৫ মিলিয়ন এবং কানাডাতে ২.৬ মিলিয়ন ডলার নিয়ে মামলা বিচারাধীন।

অন্য খবর  এগুলোই ছিল তাদের জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বাজে পরামর্শ

৪. সানি আবাচা
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণঃ ২ বিলিয়ন-৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে সানি আবাচা নাইজেরিয়ার ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৩ সালে। কিন্তু সেটি স্বপ্নই থেকে যায় নাইজেরিয়ার মানুষের জন্য! ক্ষমতায় বসার ১ বছরের মাথায় ডিক্রি জারি করে সরকারের সব কাজ আদালতের বিচারের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করেন। অর্থাৎ সরকারের কোন কাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে বিচার করতে পারবে না আদালত। সাথে সাথে নিষিদ্ধ করেন সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড। কণ্ঠরোধ করেন গণমাধ্যমের। তবে এসময়ে অবিশ্বাস্য ভাবে কিছু অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়। যেমন- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হয় ৯.৬ বিলিয়ন। কিন্তু এই সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কমনওয়েলথ থেকে বহিষ্কার করা হয় নাইজেরিয়াকে। ১৯৯৮ সালের ৮ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। কিন্তু মারা যাবার আগেই বিত্তের এক বিশাল ভান্ডার গড়ে তোলেন।

দূর্নীতিবাজ নেতা: সানি আবাচা

বিশ্ব ব্যাংকের মতে, অবৈধ সম্পদের বেশিরভাগ আসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে। কারণ সে সময় নাইজেরিয়ায় বিনিয়োগ করতে হলে বিশাল অঙ্কের ঘুষ দিতে হতো সানি কে। তার এই সম্পদের আরেকটা অংশ আসে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা থেকে। ক্ষমতায় থাকাকালীন সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেন তিনি। আর তার এই সম্পদের বিশাল অংশ তিনি পাচার করেন লুক্সেমর্বাগ, সুইজারল্যান্ড, বাহামার মতো বহু দেশে।

উদ্ধারকৃত সম্পদঃ
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া প্রায় ১.২ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেয় তার পরিবার। এছাড়াও সুইজারল্যান্ড থেকে দুই দফায় ফেরত আসে ৫০৫ মিলিয়ন আর ৩০৮ মিলিয়ন ডলার। বাহামা, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় এখনো এই অর্থ উদ্ধারের জন্য বিচার চলছে।

৩. মোবুতো সেসে সেকো
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণঃ ৪-৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ এই বিশাল সময় কঙ্গোর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। “তোমরা চুরি করো, কিন্তু অল্প অল্প করে করো। একবারে বেশি করলে পুলিশ ধরবে”। এটি ছিলো তার দলের লোকজনের প্রতি উপদেশ। ক্ষমতা ছাড়ার পর প্রথমে তিনি টোগো, আর তারপর মরক্কো পালিয়ে যান। দুর্নীতির মাধ্যমে গড়া তার সম্পদের হিসাব পাওয়া যায় খুব কম। নানা উপায়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাচার করেন সেগুলো।

দূর্নীতিবাজ নেতা:মোবুতো সেসে সেকো

সুইজারল্যান্ড সরকার ২০০৯ সালে তার ৬.৬৮ মিলিয়ন ডলার, যা সুইস ব্যাংকে ছিলো তা ফেরত দিতে চাইলেও কঙ্গো সরকারের অসহযোগিতার কারণে ফেরত দিতে পারেনি। সে সময় উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলো মোবুতোর ছেলে।

২. ফার্দিনান্দ মার্কোস
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণঃ ৫-১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ফিলিপাইনের দশম প্রেসিডন্ট নির্বাচিত হন ১৯৬৫ সালে। তার ২১ বছরের শাসন আমলে ১৯৭২ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলন ঠেকাতে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে জারি করেন সামরিক আইন। সুদীর্ঘ এই সময়ে ফিলিপাইন এশিয়ার সব থেকে ঋণগ্রস্থ দেশে পরিণত হয়। হু হু করে দারিদ্রের হার বেড়ে যায় দেশটিতে। ৩৫ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে আসে।

অন্য খবর  সোনার মানুষেরা: নটর ডেম কলেজের প্রথম বাংলাদেশি অধ্যক্ষ নবাবগঞ্জের অমল গাঙ্গুলী

দেশের মানুষের অবস্থা যাই হোক, তিনি আর তার পরিবার কিন্তু হাজার হাজার কোটি ডলারের মালিক হয়ে শুরু করেন নবাবী জীবন যাপন। রাজধানী ম্যানিলায় ছিলো বিশাল এক প্রসাদ। ৮৮৮টি হ্যান্ড ব্যাগ, ৭১টি সানগ্লাস, ২১ মিলিয়ন ডলারের সোনার গয়না ছিল তার পত্নীর নিত্য দিনের ব্যবহার করা সামগ্রী।

দূর্নীতিবাজ নেতা:ফার্দিনান্দ মার্কোস

উদ্ধারকৃত সম্পদঃ
ক্ষমতা থেকে চলে যাবার পর পরবর্তী সরকার “The Presidential Commission on Good Government (PCGG)” নামে একটি কমিশন গঠন করে তার অবৈধ সম্পদ উদ্ধারের জন্য। এই কমিশন ৩.৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ উদ্ধার করতে পারে। বাকি সম্পদ উদ্ধারের চেষ্টা এখনো চলছে।

১. মোহাম্মদ সুহার্তো
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণঃ ১৫-৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আমাদের তালিকার এক নাম্বারে আছেন ইন্দোনেশিয়াকে ৩১ বছর শাসন করা মহা দুর্নীতিবাজ এক শাসক। তার শাসনামলে তিনি ইন্দোনেশিয়াকে অনেক দিক দিয়ে নানা উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। দারিদ্র্যের হার ৪৫ ভাগ থেকে নেমে হয় ১১। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনগণের জীবনমান উন্নয়ন হয় ব্যাপক হারে। ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবার জন্য FAO-এর কাছ থেকে গোল্ড মেডেল পায়।

দূর্নীতিবাজ নেতা:মোহাম্মদ সুহার্তো

তবে ১৯৯০ সালের দিকে এসে তার ও তার স্বজনদের দুর্নীতি অতিষ্ঠ করে তোলে মানুষকে। ধস নামে জনপ্রিয়তায়। দুর্নীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ব্যাংক ঋণ, কর মওকুফের মতো সুবিধা ছিলো শুধু তার সন্তান আর স্বজনদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার দৌরাত্ম্য দূর করতে ঘুষ দিতে হতো সুহার্তোর পরিবারের লোকজনকে। সুহার্তোর জীবনী নিয়ে কাজ করা রবার্ট এলসন সে সময়ের দুর্নীতি নিয়ে বলেছিলেন, “দুর্নীতি বা ঘুষ সেখানে ম্যাকডোনাল্ড বা সাবওয়ের বার্গারের মতো। সবাই জানতো কোথায়, কখন, কিভাবে দিতে হবে।” ১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়েন তিনি।

উদ্ধারকৃত সম্পদঃ
২০০৭ সালে ১.৫ বিলিয়ন ডলার উদ্ধারে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, কিন্তু তার কিছুদিন পরেই তিনি মারা যান। ২০১০ সালে তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করে ৩০৭.৪ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করে দেশটির সরকার।

যদি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে এই রকম দুর্নীতি না হতো, যদি শাসকেরা জনগণ আর দেশের কথা না ভুলে, নিজের ও পরিবারের জন্য সম্পদের অসীম পাহাড় না গড়ে তুলতেন তাহলে হয়তো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর দরকার হতো না। আসতো না আরব বসন্ত, প্রান দিতে হতো না আয়লান কুর্দিদের।

তথ্যসূত্রঃ ইনটেগ্রিটাস360।

আপনার মতামত দিন