কোন পথে বাংলাদেশ...!!

‘It’s hard to imagine what would have happened to Bangladesh had Ziaur Rahman been assassinated in 1975 instead of 1981. A failed state on the model of Afghanistan or Liberia might well have resulted. Zia saved Bangladesh from that fate.’ (page 69, BANGLADESH AND PAKISTAN, Flirting with Failure in South Asia, By William B. Milam) উইলিয়াম বি মাইলাম ২০০১ সালে পাকিস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর মি. মাইলাম দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তার গবেষণার বিষয় হচ্ছে_ লাইবেরিয়া : ব্যর্থতা থেকে উত্তরণ, বিচার বনাম পুনঃমীমাংসা, মোশাররফ-পরবর্তী পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া। তার উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা বাংলাদেশ অ্যান্ড দ্য বার্ডেন্স অব দ্য হিস্ট্রি (২০০৭) এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তান : ফ্ল্যাটিং উইথ ফেইলইউর ইন সাউথ এশিয়া (কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ২০০৯)। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে উড্র উইলসন সেন্টারের জ্যেষ্ঠ পলিসি স্কলার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, এমনকি মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রক্তঝরা দিন। সে দিন শুধু এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ আপস না সংগ্রাম এর জয়ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছিল সারা দেশ। কামান আর গোলার গর্জনে খান সেনাদের রুদ্ধশ্বাস, জঘন্য গণহত্যা, নারী ধর্ষণের লালসায় পাকিস্তানি হানাদারের নির্বিচার পৈশাচিক আচরণের সেই দিনগুলোর কথা। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশিদের নিধনযজ্ঞের নাম দিয়েছিল, ‘অপারেশন সার্চ লাইট’। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, গলে যায়, কিন্তু ইতিহাস পচে না, গলে যায় না। মাটির নিচে চাপাপড়া সহস্র বছরের বৌদ্ধবিহার যেমন প্রত্নতত্ত্ববিদরা খুঁড়ে বের করে আনেন, তেমনি ইতিহাসও আজ বেরিয়ে আসছে আপন মহিমায়। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় ছাপা হয়, ‘লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের সাথে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার’। “সেদিন চট্টগ্রামে যেমন করে স্বাধীনতার লড়াই শুরু হয়েছিল’ শীর্ষক ওই সাক্ষাৎকারে জিয়াউর রহমান বলেন_ ‘বাংলাদেশের ওপর বর্বর হামলার প্রস্তুতি দেখতে এলেন পাক সেনাবাহিনীর জেনারেল হামিদ খান। ২১শে মার্চ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তাকে আপ্যায়িত করা হলো মধ্যাহ্নভোজে। এই মধ্যাহ্নভোজেই পশ্চিমা সামরিক অফিসারদের কানাঘুষা আর জেনারেল হামিদের একটি ছোট্ট উক্তিতে বাঙালি অফিসাররা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন দিন ঘনিয়ে এসেছে। হামলা অত্যাসন্ন। মধ্যাহ্নভোজে জেনারেল হামিদ বাঙালি অফিসারদের যেন চিনতেই পারেননি। তার যত কানাঘুষা আর কথাবার্তা চলছিল পশ্চিমা অফিসারদের সাথে। কি এত কানাঘুষা? কিসের এত ফিসফাস? সন্ধিগ্ন হয়ে উঠছিল জিয়ার মন। কৌশলে অন্য একজনের সাথে কথা বলতে বলতে গিয়ে দাঁড়ালেন জেনারেল হামিদের ঠিক পিছনে। দাঁড়ালেন পেছন ফিরে। কথা বলতে লাগলেন সঙ্গীটির সাথে আর দু-কান সজাগ রাখলেন জেনারেল হামিদের কথার দিকে। জেনারেল হামিদ তখন কথা বলছিলেন ২০তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল ফাতেমীর সাথে। অনেক কথার মধ্যে অনেকটা যেন সামরিক নির্দেশের মতোই কর্নেল ফাতেমীকে বলে উঠলেন জেনারেল হামিদ, দেখ ফাতেমী অভিযান (অ্যাকশন) খুব দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে হতে হবে। আমাদের পক্ষে কেউ যেন হতাহত না হয়। অাঁতকে উঠলেন মেজর জিয়া। একি? কি হতে যাচ্ছে? এই দিনই বিকেলে তিনি সস্ত্রীক এক সৌজন্য সাক্ষাতে গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাসায়। কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন জেনারেল হামিদের সফরের উদ্দেশ্য কিন্তু ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সে তথ্য ছিল অজানা। তিনি শুধু বললেন, ওরা আমাকে বিশ্বাস করে না। তিনি জানালেন জেনারেল হামিদ যখন অপারেশন রুমে ছিল তখন তাকে সে ঘরে ঢুকতেই দেওয়া হয়নি। : কি বুঝলেন? জানতে চাইলেন মেজর জিয়া। মনে হচ্ছে সামথিং ফিশি। জিয়া বলেন ফিশি নয়_ বিরাট কিছু। বিরাট এক চক্রান্তে মেতেছে ওরা। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মেনে নিলেন সে কথা। পর দিন ২২শে মার্চ। রাত ১১টায় চট্টগ্রাম ইপিআর সেক্টর সদর দফতরের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিক এসে দেখা করেন মেজর জিয়ার সাথে। তিনি সরাসরি বলেন, সময় খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদেরকে বিদ্রোহ ঘোষণা করতেই হবে। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আপনি বিদ্রোহ ঘোষণা করুন। ইপিআরদের সাহায্য পাবেন। মেজর জিয়া তাকে তাদের পরিকল্পনার কথা শোনান এবং ইপিআর এর সাহায্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। ২৫শে মার্চ ব্যাপক রদবদল ঘটে গেল ক্যান্টনমেন্টের প্রশাসন ব্যবস্থায়। ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে এলেন জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, জেনারেল আনসারী, মেজর জেনারেল মিঠা খান, লে. জেনারেল খোদাদাদ খান প্রমুখ। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। সেই সাথে নিয়ে গেলেন মেজর আমিন আহমদ চৌধুরীকেও। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের স্থানে আনসারী নিযুক্ত হলেন। স্টেশন কমান্ডার কর্নেল শিগারী দায়িত্ব নেন ইপিআর এর সেন্টার কমান্ডার হিসেবে। এই রদবদলে আশঙ্কিত হয়ে উঠেন বাঙালি সৈনিক ও অফিসাররা। এই দিনই গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী। এদিকে চট্টগ্রাম শহরে উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছিল প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে না পেঁৗছাতে পারে তার জন্যে রাস্তায় রাস্তায় তৈরি করা হয়েছিল ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগানো হলো বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চললো এই ব্যারিকেড সরাবার কাজ। রাত ১১টায় অফিসার কমান্ডিং জানজুয়া আকস্মিকভাবে মেজর জিয়ার কাছে নির্দেশ পাঠালেন এক কোম্পানি সেনা নিয়ে বন্দরে যাবার জন্যে। এই আকস্মিক ও রহস্যজনক নির্দেশের অর্থ তার কাছে বোধগম্য হলো না। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায় জানজুয়া নিজে এসে তাকে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোলশহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করে দেন। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেড সরিয়ে যেতে তার দেরি হচ্ছিল। আগ্রাবাদে যখন একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তার ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে তখনই পেছন থেকে ছুটে আসে একটি বড় গাড়ি। ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান। গাড়ি থেকে নেমেই তিনি দৌড়ে আসেন মেজর জিয়ার কাছে। হাত ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে যান রাস্তার ধারে। পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরের বহু লোক হতাহত হয়েছে। খালিকুজ্জামানের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর থেকে কথা ঝরে পড়ে। কি করবেন জিয়া ভাই এখন? মাত্র আধ মিনিট গভীর চিন্তায় তলিয়ে যান মেজর জিয়া। তারপর বজ্র নির্ঘোষে বলে ওঠেন_ ওই রিভোল্ট। সাথে সাথে তিনি খালিকুজ্জামানকে ফিরে যেতে বলেন। বলেন ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্যে ওয়ালী আহমদকে নির্দেশ দিতে। আর সেই সাথে নির্দেশ পাঠান ব্যাটালিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতারের। খালিকুজ্জামান দ্রুত ফিরে গেলেন ষোলশহরের দিকে। আর মেজর জিয়া ফিরে এলেন ট্রাকে। যে পশ্চিমা সামরিক অফিসারকে তার সাথে দেওয়া হয়েছিল তাকে বলেন হুকুম বদলে গেছে বন্দরে যেতে হবে না। আমাদের এখন ফিরে যেতে হবে ক্যান্টনমেন্টে। বাঙালি সৈন্য যারা তার সাথে যাচ্ছিলেন তাদেরকে ইশারায় বললেন রাইফেল লোড করে রাখতে। প্রয়োজন হতে পারে। তারা ফিরে আসেন ব্যাটালিয়নে। এসেই তিনি সাথের পশ্চিমা অফিসারকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি এখন আমাদের হাতে বন্দী। অফিসারটি আত্দসমর্পণ করলে তিনি ট্রাক থেকে নেমে ট্রাকের পশ্চিমা নৌসেনাদের দিকে রাইফেল তাক করে তাদেরকেও অস্ত্র ছেড়ে আত্দসমর্পণ করতে বলেন। হতচকিত পশ্চিমা সেনারা সবাই আত্দসমর্পণ করে। এরপর তিনি একাই একটি গাড়ি নিয়ে ছুটে যান অফিসার কমান্ডিং জানজুয়ার বাড়ি। কলিং বেল টিপতেই ঘুম ভেঙে উঠে আসেন জানজুয়া। আর সামনেই মেজর জিয়াকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন। তার ধারণা ছিল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর জিয়া বন্দরে বন্দী হয়ে রয়েছেন। জানজুয়াকে গ্রেফতার করে নিয়ে ষোলশহরে ফিরে আসেন মেজর জিয়া। পথে অফিসার্স মেসে মেজর শওকতকে তিনি সব কথা বলতেই মেজর শওকত উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন এবং বিদ্রোহে তার যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দ্রুত ব্যাটালিয়নে চলে আসেন। এরপরই মেজর জিয়া টেলিফোনে স্থানীয় জননেতা ও বেসামরিক অফিসারদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু কাউকেই পান না। তখন টেলিফোন এঙ্চেঞ্জের অপারেটরকে তিনি অনুরোধ জানান সবার কাছে টেলিফোন করে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের বিদ্রোহ ঘোষণার কথা জানাতে। অপারেটর সানন্দে তার সে নির্দেশ জানাতে রাজি হন। তিনি লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীকেও টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকেও পাননি। পরে শুনেছিলেন এই রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা গুরুতর অসুস্থ এম আর চৌধুরীকে হত্যা করেছিল। শুরু হয়ে গেল বিদ্রোহ। রাত তখন দুটো। ব্যাটালিয়নের আড়াইশোর মতো বাঙালি সৈন্যকে একত্রিত করে তাদেরকে সব কথা বলেন মেজর জিয়া। সবাই একবাক্যে এই বিদ্রোহের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। তারা জানান দেশের স্বাধীনতার জন্যে তারা জান দিতে প্রস্তুত। কিছু সৈন্য ষোলশহরে রেখে বাকি সবাইকে নিয়ে মেজর জিয়া বেরিয়ে পড়েন কালুরঘাটের পথে। এদিকে ইপিআরের জওয়ানরাও লড়াই শুরু করেছিলেন। কালুরঘাটে পরদিন তাদের সাথে বেশ কিছু পুলিশও যোগ দেন। ২৬শে মার্চ সকাল। আগের রাতে ঢাকা শহরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে রাজধানীর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। আর সেই আনন্দে সকাল হতেই পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডারের সদর দফতরে চলছিল মিষ্টি বিতরণ আর অভিনন্দন বিনিময়ের পালা। কিন্তু মুহূর্ত কয়েক পরেই তাদের মুখের হাসি ম্লান হয়ে যায়। মিষ্টি হয়ে যায় বিস্বাদ। চট্টগ্রামের যুদ্ধের খবর যখন তাদের কাছে পেঁৗছাল তখন এক দারুণ সন্ত্রাসে অাঁতকে উঠলেন তারা। চট্টগ্রাম। পাকিস্তানিদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল চট্টগ্রাম। ২৭শে মার্চ সকালেই বিমান বোঝাই হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে গেল পুরো দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। চট্টগ্রাম যুদ্ধের পরিকল্পনা তৈরির জন্যে মিঠা খানকে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয় চট্টগ্রামে। বাঙালি সৈন্যরা গুলি করে সে হেলিকপ্টারটি ফুটো করে দেয়। একই সাথে বিমানে করে নামানো হতে লাগল দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে। নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বাবরকে নিয়ে আসা হয় বন্দরে। এতে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ডেস্ট্রয়ার, এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্কও লাগানো হয় এই যুদ্ধে। জাহাজের গান থেকেও গোলা নিক্ষেপ হতে থাকে শহরের দিকে। এই বিরাট শক্তির মোকাবিলায় বেশিক্ষণ টিকে থাকা সম্ভব হবে না এ কথা বাঙালি সৈন্যরা বুঝেছিলেন। তাই শহর ছেড়ে যাবার আগেই বিশ্ববাসীর কাছে কথা জানিয়ে যাবার জন্যে মেজর জিয়া ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা মেজর জিয়াকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। কি জানাবেন তিনি বিশ্ববাসী এবং দেশবাসীকে বেতার মারফত? এদিকে বেতার কর্মীরা বার বার ঘোষণা করছিলেন আর পনেরো মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু পনেরো মিনিট পার হয়ে গেল। মেজর জিয়া মাত্র তিন লাইন লিখতে পেরেছেন। তখন তার মানসিক অবস্থা বুঝাবার নয়। বিবৃতি লেখায় ঝুঁকিও ছিল অনেক। ভাবতে হচ্ছিল শব্দচয়ন, বক্তব্য পেশ প্রভৃতি নিয়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা মোসাবিদার পর তিনি তৈরি করেন তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। নিজেই সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত কালুঘাটে থেকে তারা চট্টগ্রামের যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাদের সাথে যুদ্ধে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল ২০তম বালুচ রেজিমেন্ট, কুমিল্লা থেকে নিয়ে যাওয়া ৫৩ ব্রিগেড। আর নিশ্চিহ্ন হয়েছিল কমান্ডো যারা অবাঙালিদের ঘরে ঘরে ঘাঁটি গেড়েছিল। এদেরকে ছাড়াও চট্টগ্রামের এই যুদ্ধে বাঙালিদের বিরুদ্ধে লাগানো হয়েছিল কোয়েটা থেকে নিয়ে আসা ১৬শ ডিভিশন ও প্রথম কমান্ডো ব্যাটালিয়নকে। ৩০শে মার্চ সকালে মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র) থেকে আর এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সেনা বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনই দুটি পাকিস্তানি বিমান থেকে গোলাবর্ষণ করে বেতার কেন্দ্রটিকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১১ই এপ্রিল কালুরঘাট এলাকা থেকে অবস্থান সরিয়ে নেবার পর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এ যুদ্ধ চলে রামগড়, রাঙ্গামাটি এলাকায়। যুুদ্ধ চলে কঙ্বাজারের পথে, শোভাপুরে। যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম থেকেই দলে দলে জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্ররা এসে যোগ দিয়েছে বাহিনীতে। অস্ত্র ধরেছে, ট্রেনিং নিয়েছে, বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে। ৩০শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যাবার পর ৩রা এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টায় পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন একটি গোপন এলাকা থেকে চালু করা হয় আর একটি বেতার কেন্দ্র। আমার সোনার বাংলা দিয়ে করা হয় এই কেন্দ্রের উদ্বোধন। এই গানটি গাইবার জন্যে সে রাতে সেখানে এসেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের তদানীন্তন পুলিশ সুপার জনাব রহমানের তিন মেয়ে।” আজ ৩০ মে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৩২তম শাহাদাতবার্ষিকী। বার বার মনে পড়ছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলোর কথা। ৪২ বছর আগের ঘটনা। স্মৃতির মানসপটে যা শুধু অস্পষ্টই নয়, মরীচিকা নয়, যা মাটি চাপা পড়ে আছে, ইতিহাস পাল্টে যাচ্ছে। দীর্ঘ নয়টি মাস, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে পেলাম একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, লাল সবুজের রক্তে রঞ্জিত পতাকা। বহু চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার অনেক দূর পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ। পথটি কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ধাবমান এ দেশটি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার ১৭৩ দিনের হরতালের ফসল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবদান বর্তমান মহাজোট সরকার। পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথা বাতিল করে জাতিকে আজ অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মহাজোট সরকার। ধর্মনিরপেক্ষতার আবর্তনে শাহবাগী আর তৌহিদী জনতার সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করছে এই মহাজোট সরকার। এরই সন্ধিক্ষণে ওয়াশিংটন ডিসিতে উড্র উইলসন সেন্টারের জ্যেষ্ঠ পলিসি স্কলার মি. মাইলাম স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, শহীদ জিয়ার বীরত্বগাথা, অতীতের ঘটে যাওয়া ঘটনাবহুল ইতিহাস। ২০০৯ সালে এসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ফ্ল্যাটিং উইথ ফেইলইউর ইন সাউথ এশিয়া বইটিতে মি. মাইলাম লিখেছেন, ‘এটা কল্পনা করাই খুব কঠিন যদি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের পরিবর্তে ১৯৭৫ সালে বিশ্বাসঘাতক আততায়ীর হাতে নির্মমভাবে গুপ্তহত্যার শিকার হতেন তাহলে এ দেশটির আফগানিস্তান বা লাইবেরিয়ার মতো অকার্যকর রাষ্ট্রের ভাগ্যবরণ করতে হতো। জিয়া বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রের ভবিতব্য থেকে রক্ষা করেছিলেন।…’!!

অন্য খবর  মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হচ্ছে কেন

আ ন ম এহছানুল হক মিলন

লেখক : সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী

ই-মেইল : ehsanulhoquemilan@gmail.com

আপনার মতামত দিন