আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হরহামেশা পরিবর্তন

697

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম পাশ নম্বর ছিল ১০০তে ৩৩ নম্বর। পাবলিক পরীক্ষায় ৩৩০ থেকে ৪৪৯ পর্যন্ত ৩য় বিভাগ, ৪৫০ থেকে ৫৯৯ পর্যন্ত ২য় বিভাগ, ৬০০ থেকে ৭৪৯ পর্যন্ত ১ম বিভাগ এবং ৭৫০ বা তার চেয়ে বেশি নম্বর পেলে স্টার মার্কস ধরা হতো। বিশদ আকার প্রশ্ন, সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন, এক কথায় প্রকাশ, পার্থক্য নির্ণয়, মিলকরণ, শূন্যস্থান পূরণ ইত্যাদি ধরণের প্রশ্ন পরীক্ষায় লিখতে হতো। এরপর পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসলো। নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন এবং রচনামূলক প্রশ্নের উত্তর দিতে হতো। প্রথম দিকে প্রশ্নব্যাংক নামক সীমিত সংখ্যক নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন পড়ে পরীক্ষায় তথাকথিত ভাল রেজাল্ট করার সুযোগ তৈরি হল। ফলে রচনামূলক অংশে খুবই কম নম্বর পেয়ে নৈর্ব্যক্তিক অংশে বেশি নম্বর পেয়ে খুব সহজেই ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হল। পরবর্তিতে অবশ্য নৈর্ব্যক্তিক ও রচনামূলক অংশে আলাদা পাশের নিয়ম করার ফলে তথাকথিত ভাল ফলাফল করা এবং পাশ করা কিছুটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। অল্প সময়ের মধ্যেই পাঠ্যপুস্তক বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হতে লাগল। ২০০১ সনে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে গ্রেড পদ্ধতি চালু হল। গ্রেড পদ্ধতি বুঝতে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এমনকি শিক্ষকদের দু’এক বছর লেগে গেল। প্রথম দিকে এস এস সি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েও কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হল। অবশ্য দু’এক বছর পর এই নিয়মটা বাতিল হল। এখনো এস এস সি পরীক্ষায় এক থেকে চার বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা পরবর্তী বছর শুধুমাত্র অকৃতকার্য বিষয়সমূহে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।  অথচ বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে প্রমোশন দিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

অন্য খবর  বাহ্রা-অরঙ্গবাদ বাঁধের নাম-বিতর্ক প্রসঙ্গে

এরই মাঝে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় এসবিএ পদ্ধতি চালু হল। বিষয়টি বুঝতে এবং বাস্তবায়ন করতে শিক্ষকদের হিমশিম খেতে হল। এরপর কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপদ্ধতি চালু হল যা বুঝতে এবং বুঝাতে আমার মত অনেক শিক্ষকই ব্যর্থ হলেন। এরপর আসল সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি। এই পদ্ধতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে আরও কঠিন হয়ে দেখা দিল। প্রথমদিকে ৪০ নম্বরের নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন এবং ৬০ নম্বরের ৬টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে হত।  পরবর্তিতে ৭০ নম্বরের ৭টি সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর লিখতে বলা হলে শিক্ষার্থীরা এই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়। আজও অনেকেই বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষকরাই বুঝেন না, ছাত্রদের বুঝাবেন কীভাবে?

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি ও জেএসসি পরীক্ষা নামে দুটি পাবলিক পরীক্ষা অল্প বয়সের শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল। পাঠ্য বইয়ের সংখ্যা এবং বিষয়ের সংখ্যা বাড়ানো হল। এরপর পাবলিক পরীক্ষার বিষয় সংখ্যা কমিয়ে কয়েকটি বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের অন্তর্ভুক্ত করা হয় যা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে; বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ নেই বললেই চলে। জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০এ বলা হল ১ম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, ৯ম থেকে ১২শ পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এবং তৎপরবর্তী শ্রেণিসমূহ উচ্চ শিক্ষা বলে গণ্য হবে। শুধুমাত্র জে এস সি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ছাড়া জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ এর আর কোন সফলতা বাস্তবে রূপ পেয়েছে বলে মনে হয় না। জাতীয় শিক্ষা আইনের খসড়া চোখে পড়লেও এর চূড়ান্ত রূপ আলোর মুখ দেখেনি। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা শুধুমাত্র কাগজেই রয়ে গেল। অতি সম্প্রতি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে জিপিএ এর পরিবর্তে সিজিপিএ প্রবর্তনের কথা শুনা যাচ্ছে। একই সাথে গ্রেড পদ্ধতিরও পরিবর্তন করা হবে বলে খবরে প্রকাশ।

অন্য খবর  দোহারে আর্ন্তজাতিক সাক্ষরতা দিবসে বর্ণাঢ্য র‌্যালি

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে এত সব পরিবর্তন শিক্ষার মান উন্নয়নে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছে? আমরা এ কথা বলে তুষ্টি লাভ করি যে, আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু শিক্ষার মান বেড়েছে কতটুকু? আজকাল অনেক উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা বাংলায় একটা আবেদন লিখতে পারেন না। শুধুমাত্র সার্টিফিকেট অর্জন করে কী লাভ? কাজেই শিক্ষার হার বৃদ্ধির পাশাপাশি এর গুণগত মান বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করার সময় এখনো কি আসেনি?

হারুন অর রশীদ

সহকারী প্রধান শিক্ষক

বারুয়াখালী উচ্চ বিদ্যালয়

আপনার মতামত দিন